মঙ্গলবার   ১৭ জুন ২০২৫ || ২ আষাঢ় ১৪৩২

দৈনিক গাইবান্ধা

প্রকাশিত : ১৬:০৪, ১৭ জুন ২০২৫

জেন–জিদের জন্য কেমন হবে রূপচর্চা

জেন–জিদের জন্য কেমন হবে রূপচর্চা
সংগৃহীত

‘স্কিন কেয়ার’ বা ত্বকের যত্নে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন সব কায়দা-কানুন। কিশোর ও তরুণ; অর্থাৎ জেন-জি, ১৩ থেকে ২৮–এর কোঠায় যাঁদের বয়স, তাঁরা ত্বক সুন্দর রাখতে প্রতিনিয়তই আয়ত্ত করছেন নতুন নতুন ট্রিকস অ্যান্ড টিপস। জেনারেশন এক্সদের কথা বাদই দিলাম, জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালরাও কয়েক বছর ত্বকের যত্নের ওপর মনোযোগ বাড়িয়েছেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে জেন-জিরা কিন্তু এখন থেকেই সচেতন। ত্বকের যত্নের রুটিনে একের পর এক জুড়ে নিচ্ছেন নতুন নতুন পণ্য। আর এতেই বাধছে বিপত্তি!

ত্বকের ব্যাপারে জেন–জিদের আরও একটু ধীরস্থির হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অরোরা স্কিন অ্যান্ড এসথেটিকসের চেয়ারম্যান, ত্বকবিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক অধ্যাপক সৈয়দ আফজালুল করিম এবং সৌন্দর্যসেবা কেন্দ্র রেডের প্রতিষ্ঠাতা ও রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। এই বয়সে ফিটফাট ত্বক পেতে তাঁদের থেকেই পাওয়া গেল কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ।

ত্বকের যত্নে বয়সের গুরুত্ব

শিশুর মসৃণ ত্বক কৈশোরে অন্য রকম দেখাবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে উঁকি দিতে শুরু করে ত্বকের নানা সমস্যা। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ত্বক কেমন হবে, কতটা সুস্থ থাকবে, এটা ব্যক্তির জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করলেও ঠিকঠাক যত্নে ত্বক এমনিতেই ভালো থাকে, জানান আফজালুল করিম। তিনি বলেন, ত্বকের যত্নের পুরো বিষয়টাই বয়সনির্ভর। কিশোর বয়সের ত্বকের সমস্যা প্রাপ্তবয়স্কদের উপযুক্ত কোনো পণ্য ব্যবহার করে সমাধান করা যাবে না। প্রাপ্তবয়স্করা যেভাবে ত্বকের যত্ন নেবেন এবং যা ব্যবহার করবেন, কিশোর বয়সীদের সেগুলো থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ত্বকের সমস্যা বোঝার পাশাপাশি বয়স অনুযায়ী ত্বকের যত্ন নিতে হবে। কোন বয়সের ত্বকের চর্চা কেমন হবে, বুঝতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন স্কিনকেয়ার ট্রেন্ড বা রূপচর্চার চলতি ধারা দেখে ত্বকচর্চা থেকে বিরত থাকতে হবে। না হলে পরে ত্বক আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।

‘সিএমএস’ রুটিন

কিশোর বয়সে ত্বকের পরিবর্তন আটকে রাখা যাবে না। হঠাৎ ব্রণ দেখা দিলে ঘাবড়ে যাওয়া যাবে না। এ সময় না জেনে-বুঝে কিংবা লোকের কথায় অনেক বেশি কিছু ত্বকে ব্যবহার করা অনুচিত। প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে, শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এমনটি হতেই পারে। তবে এ বয়স থেকেই ত্বক সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে বললেন আফরোজা পারভীন। তিনি বলেন, প্রথমেই নিজেকে পরিষ্কার রাখা শিখতে হবে। দিনে কয়েকবার পানি দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করলেই হলো। তবে ব্রণের সমস্যা থাকলে ত্বক অনুযায়ী ফেসওয়াশ ব্যবহার করা যেতে পারে। কৈশোরে ত্বকের যত্নে যত কম জিনিস ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো, এমনটাই মনে করেন এই রূপবিশেষজ্ঞ। শুধু মেয়েদের নয়, একই পরামর্শ ছেলেদের দিয়েও আফরোজা বলেন, ত্বকের যত্ন করা তো মেকআপ করা নয়। এটা আত্মযত্নের অংশ। ছেলেদেরও এ বয়স থেকেই ত্বকের যত্ন নেওয়া শিখতে হবে।

আজকাল শিশুদের কেন্দ্র করে ত্বকে ব্যবহৃত পণ্যের একটা বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। দেশি-বিদেশি পণ্যের রঙিন মোড়ক আর মজার সব নামে আকৃষ্ট হচ্ছে শিশুরা। তার ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব তো আছেই। এই তো কিছুদিন আগেই টিকটক-ইনস্টাগ্রামে কিশোর বয়সী একদল অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারের ‘সেফোরা কিডস’ নামে ডাকা হচ্ছিল। ত্বকচর্চার বিভিন্ন পণ্য নিজের ত্বকে ব্যবহার করে এরা মূলত ভিডিও তৈরি করে। ব্যাপারটি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশ-বিদেশের ত্বকবিশেষজ্ঞরা। এ বয়সে ত্বকে অনেক জিনিস ব্যবহার না করে ‘সিএমএস’ রুটিন মেনে চলার পরামর্শ দেন তাঁরা। সিএমএস, অর্থাৎ ক্লিনজার, ময়েশ্চারাইজার ও সানস্ক্রিন—এ তিনটি জিনিস হলেই যথেষ্ট।

তরুণ ত্বকে যেমন যত্ন যা করতে হবে

  • ত্বকের ধরন অনুযায়ী একটি ক্লিনজার বা ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে হবে। শুষ্ক ত্বক হলে তেলভিত্তিক ক্লিনজার ব্যবহার করতে পারেন। তৈলাক্ত ত্বক হলে পানি বেশি আছে, এমন ক্লিনজার বা পরিষ্কারক ব্যবহার করতে হবে। ব্রণ হলে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, গ্রিন টি, বেনজোয়েল পার–অক্সাইড, টি ট্রি অয়েল যুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করতে পারেন।

  • ত্বক অনুযায়ী টোনার ব্যবহার করা ভালো। টোনারের ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক করে ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ফিরিয়ে দেয়। টোনারের কার্যক্ষমতা এর উপাদানের ওপর নির্ভর করে। এটি পানির মতো হওয়ায় সরাসরি হাতে বা তুলায় নিয়ে মুখে ব্যবহার করতে হবে।

  • রোদ হোক বা বৃষ্টি, সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে ভুলবেন না। এটা ছেলে বা মেয়ে, সবার জন্য প্রযোজ্য।

  • নতুন কোনো পণ্য ত্বকে ব্যবহারের পর যদি ত্বক জ্বালাপোড়া করে বা লালচে হয়, তাহলে সেটি আর ব্যবহার না করাই ভালো।

  • ত্বকে যেকোনো নতুন কিছু ব্যবহার করতে চাইলে প্রথমে সপ্তাহে এক বা দুই দিন ব্যবহার করে ত্বককে অভ্যস্ত করে নিতে হবে।

  • ত্বককে সিরামের সঙ্গে পরিচিত করাতে পারেন এ বয়সে। ত্বকের সমস্যা অনুযায়ী যেকোনো একটি বা দুটি সিরাম যুক্ত করে নিতে পারেন প্রতিদিনকার স্কিন কেয়ার রুটিনে।

সিরাম কী এবং কেন

ত্বকের নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানে কাজ করে সিরাম। সমস্যাগুলোর বেশির ভাগই শুরু হয় সাধারণত কিশোর বয়সের পর। তাই কৈশোরে সিরাম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেন চিকিৎসকেরা। প্রাপ্তবয়সে সিরাম ব্যবহার করতে চাইলে ত্বকের সমস্যা অনুযায়ী বেছে নিতে হবে। যেমন ব্রণ হলে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, নায়াসিনামাইড সিরাম ব্যবহার করা যেতে পারে। ত্বকে কালচে দাগ বা মলিন দেখালে আলফা আরবুটিন, ল্যাকটিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, নায়াসিনামাইড সিরাম বেশ ভালো কাজ করে। শুষ্ক ত্বকের জন্য উপকারী সিরাম হলো হায়ালুরোনিক অ্যাসিড। ত্বকের দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে পারে রেটিনল। কোনো কোনো সিরাম ত্বকের মৃত কোষ দূর করে ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। সিরাম ব্যবহারের আগে অবশ্যই এর সঠিক মাত্রা নিশ্চিত করতে হবে। সিরামের বোতলে লেখা ব্যবহারবিধি ভালো করে পড়ে নিতে হবে। না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

ট্রেন্ডের ফাঁদে

ত্বকের নানা সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত থাকেন তরুণ বয়সীরা। অনলাইনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ত্বকচর্চার বিভিন্ন ট্রেন্ডের ফাঁদে তাঁরাই বেশি পড়েন। ১৮ বছর বয়সী রুহিনা তারান্নুমের সঙ্গে যেমনটা ঘটেছে। বেশ কয়েক দিন আগে ইনস্টাগ্রামে ‘স্লাগিং’ পদ্ধতিতে ত্বকের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটি জানতে পারেন তিনি। এ পদ্ধতিতে মুখের ত্বকে অনেক বেশি করে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে ঘুমাতে যেতে হয়। ত্বকে শুষ্কতা দূর করতে টানা দুই দিন ত্বকে স্লাগিং করেন রুহিনা। তৃতীয় দিন দেখতে পান মুখে ছোট ছোট ব্রণ উঠছে। এরপর রুহিনার সিদ্ধান্ত, অনলাইনে যা দেখব, তা–ই করা যাবে না।

রূপচর্চা নিয়ে ইন্টারনেটে এত তথ্যের মধ্যে খারাপ-ভালো সবই আছে, বলেন আফরোজা পারভীন। কিন্তু প্রত্যেকের ত্বক আলাদা। আরেকজনের ত্বকে যা কাজ করবে, আপনার ত্বকে তা কাজ না করে উল্টো ক্ষতি করতে পারে। তাই অনলাইন ট্রেন্ড অনুযায়ী ত্বকের যত্ন না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সমস্যা অনুযায়ী সমাধান

জেন–জিদের অনেকে ইন্টারনেট ঘেঁটে ত্বকের সমস্যার লক্ষণ অনুযায়ী নিজেরাই বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করছেন। পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখেও প্রভাবিত হচ্ছেন তাঁরা। আবার একটি পণ্য আরেকজনের ত্বকে কাজ করেছে দেখে নিজেও ব্যবহার করছেন। এভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বলছিলেন আফজালুল করিম। তিনি বলেন, ত্বকের যেকোনো সমস্যায় আগে রোগ নির্ণয় করতে হবে, তারপর ত্বকের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

‘ক্রিম মেখে ফরসা হতে হবে না’

রং ফরসাকারী ক্রিমের অপব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ভিডিও বার্তা দিয়ে আসছিলেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মেহেজাবীন হোসেন। এই ইনফুয়েন্সার বলেন, ত্বক ফরসা করতে গিয়ে অনেকেই ত্বকের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই এটা–সেটা মেখে ফরসা হওয়ার চেষ্টা না করে ত্বক সুন্দর রাখার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আফজালুল করিম বলেন, তীব্রমাত্রার স্টেরয়েড থাকায় এগুলো ত্বকের জন্য ভয়াবহ। এগুলো ব্যবহারে অল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ ত্বক ফরসা হয়ে গেলেও কিছুদিনের মধ্যেই ত্বক একবারে নষ্ট হয়ে যায়। তাই ভুলেও এগুলো ব্যবহার করা যাবে না।

প্রতিদিনই ‘মি টাইম’

ত্বকের জন্য দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখেন জেন–জিরা। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগের সময়টাই সেরা, বলছিলেন তাঁদেরই একজন। একান্তই নিজের এই সময়ের নাম দিয়েছেন ‘মি টাইম’। এ সময় নিজের কাজগুলো করে নেওয়ার ফাঁকে ত্বকচর্চাটাও সেরে নিচ্ছেন এই প্রজন্মের তরুণেরা। এই মি টাইমে ত্বকচর্চার জন্য একটি নির্দিষ্ট রুটিন থাকা জরুরি, বলছিলেন সুপ্রভা মোরশেদ (২০)। না হলে নাকি ত্বকের যত্ন নেওয়া হয়ে ওঠে না। সুপ্রভা বলেন, ত্বকের উপযোগী কয়েকটি জিনিস ঠিক করে নিন। প্রতিদিন নিয়ম করে সেগুলো ব্যবহার করুন। মি টাইমে নিজের ত্বকের সঙ্গে নিজেই বোঝাপড়া করুন।

ছেলেদের ত্বকও ভালো থাকুক

ত্বকের যত্নে জোরালো কোনো রুটিন মেনে চলেন না মেহরাব হাসান (২২)। মেহরাব বলেন, ‘ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করে একটি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করি।’ আর দিনের বেলায় সানস্ক্রিন ব্যবহার করা জরুরি। ছেলেদের ত্বক ভালো রাখতে এই সাধারণ রুটিনই যথেষ্ট, জানান আফজালুল করিম। তবে যা–ই ব্যবহার করি, সেটা যেন হয় ত্বকের ধরন অনুযায়ী। যেমন তৈলাক্ত ত্বকে তেলযুক্ত কোনো পণ্য ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে ব্রণের সমস্যা হতে পারে।

কম খরচেই স্কিন কেয়ার

ত্বকের জন্য এত কিছু কেনা বেশ খরচের ব্যাপার। ত্বকে কোনো একটা ক্রিম বা সিরাম খাপ খেয়ে গেলেই হলো। সেটি শেষ হলেই নতুন করে কিনতে হচ্ছে। ত্বকের একাধিক সমস্যা থাকলে ব্যবহার করতে হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন উপকরণের সিরাম। এভাবে একাধিক পণ্য কিনতে গিয়ে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে খরচ। তাই ত্বকচর্চার খরচ কমাতে ‘মাল্টি-ইউজ’ পণ্য ব্যবহার করার পরামর্শ দিলেন আফরোজা পারভীন। বিষয়টিকে বুঝিয়ে তিনি বলেন, এমন একটি পণ্য কিনতে পারেন, যা দিয়ে একটির বদলে একাধিক সুবিধা পাওয়া যাবে। যেমন সিরামযুক্ত মুখের ক্রিম, স্ক্রাবযুক্ত ফেসওয়াশ, ময়েশ্চারাইজারযুক্ত সানস্ক্রিন ইত্যাদি। সিরাম ব্যবহার করতে চাইলে শুধু একটি উপকরণ, যেমন নায়াসিনামাইড সিরাম না কিনে নায়াসিনামাইডের সঙ্গে ভালো কাজ করে, এমন অন্তত একটি বা দুটি অন্য উপাদান মিশ্রিত আছে, এ ধরনের সিরাম নিন। এভাবে খরচও বাঁচবে, সঙ্গে একাধিক জিনিস ব্যবহারের অতিরিক্ত সময়ও বেঁচে যাবে।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ