মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ || ১ আশ্বিন ১৪৩১

প্রকাশিত : ১৭:৪২, ৯ জানুয়ারি ২০২৪

পিথাগোরাসের উপপাদ্য বনাম আলো ঝলমলে এক দুপুর

পিথাগোরাসের উপপাদ্য বনাম আলো ঝলমলে এক দুপুর
সংগৃহীত

এপ্রিলে ভিসার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম। গন্তব্য প্রফেসর আব্দুস সালামের আইসিটিপি। ইতালিয়ান দূতাবাসে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় ছোট একটি মৌখিক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল। সবার জন্য একই ব্যবস্থা কিনা জানা ছিল না। তবে আমাকে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। পরে দু’একজনের কাছে জেনেছিলাম তাদেরকেও একই সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। 

আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে বললেন, প্লিজ, গিভ ইওর সেলফ ইন্ট্রোডাকশন। আমি পরিচয় দিলাম। তারপর বললেন, হোট ইজ ইওর সাবজেক্ট? বললাম।

তারপর তাক লাগানো এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, হোট ইজ পিথাগোরাস থিওরি? প্রশ্নে অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে প্রাইমারি ঐ স্কুল শিক্ষকের মতো মনে মনে বললাম, ‘হে আল্লাহ, মাটি ফাঁক করো- আমি ভেতর ঢুকব।’  

পঞ্চাশোর্ধে এক স্কুল শিক্ষকের কাছে যখন ১০ বছরের এক স্কুলছাত্র বিড়ি ধরাবে বলে দিয়াশলাই চেয়েছিল তখন শিক্ষক উপরোক্ত ফরিয়াদ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গণিতের শিক্ষককে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার কাছে ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য কী’ জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু শেষমেশ মরে যাওয়া হয়নি। কারণ, ইতালি যাওয়ার আনন্দ বা লোভ আমাকে মরতে দেয়নি। 

আবার সেই পিথাগোরাসের উপপাদ্যের পাল্লায় পড়লাম। এ ঘটনার মাস খানিক আগে গণিত বিভাগের সভাপতির কক্ষে এ কিউ চৌধুরী নামে রাজশাহী রেঞ্জের এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসেন। কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়- কাউকে ধরতে আসলো নাকি? কারণ রাবির আট শিক্ষক আটক হওয়ার পর আমাদের অবস্থা অনেকটা ঘর পোড়া গরুর মতো হয়েছে। যাক, সব শঙ্কা দূর করে দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কিউ চৌধুরি আমাদেরকে তার গণিতের প্রতি ভালোলাগা এবং ভালোবাসার কথা শোনালেন, মেলে ধরলেন পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ডালা। 

তিনি পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করে সমকোণী ত্রিভুজের বাহুগুলোর ওপর আঁকা ঘনকের জন্য সূত্র বের করেছেন বলে দাবি করেন। পুলিশ বিভাগে চাকরি করেও গণিতের প্রতি আগ্রহ এবং পিথাগোরাসের উপপাদ্য ওপর পড়ালেখার জন্য সবাই তাকে ধন্যবাদ জানান। যেহেতু তিনি আকস্মিকভাবে এসেছিলেন এবং বিভাগে সব শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন না, তাই বিভাগের সভাপতি তার গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে গণিত বিভাগে একটি সেমিনার দিতে বলেন। এবং সেমিনারের জন্য একটা দিন নির্ধারণ করে দেন। 

সেমিনারে যাওয়ার আগে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক পিথাগোরাসকে এবং তার উপপাদ্যটি কী? পিথাগোরাস ছিলেন গ্রীসের একজন গণিত বিশারদ। খ্রি:পূঃ ৫৮৪ সালে এশিয়ার মাইনরের পশ্চিম তীরে সামোস-এ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গণিতশাস্ত্রে বিশেষত- সংখ্যাতত্ত্ব, ত্রিমাত্রিক ও ক্ষেত্রফল সম্বন্ধীয় জ্যামিতি শাস্ত্রে তিনি বেশি অবদান রাখেন। তবে তার বিখ্যাত আবিষ্কার, ‘সমকোণী ত্রিভুজের অতিভূজের উপর বর্গ অন্য দুই বাহুর উপর বর্গের সমষ্টির সমান, অর্থাৎ ক২ = খ২ + গ২’ প্রমাণটি তাকে বিশ্বে অমর করে রেখেছে। যেখানে 'ক’ হলো সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজ এবং খ ও গ ত্রিভুজের অপর দু’বাহু। 

আলো ঝলমলে এক দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে এ কিউ চৌধুরী এক সেমিনার দেন। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন গণিত বিভাগের সব শিক্ষকসহ রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি, পুলিশ সুপার এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিক ছাত্ররা। সেখানে তিনি ঘনবস্তুর ক্ষেত্রে পিথাগোরাসের উপপাদ্যের ব্যবহার এবং এ সংক্রান্ত একটি ফরমুলা উপস্থাপন করেন। তার ফর্মূলাটি ছিল এরুপঃ ক৩ = খ৩ কোসেক প+ গ৩ কোসেক ফ, যেখানে ‘প’ এবং ‘ফ’ দুটি বাহুর মধ্যে কোণ নির্দেশ করে।

এ কিউ চৌধুরী তার আবিষ্কারের পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরেন তার সঙ্গে গণিত বিভাগের প্রায় সব শিক্ষকই দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ, তিনি পিথাগোরাসের উপপাদ্যকে উভয় দিকে ‘ক’ দিয়ে গুণ করে ঘনবস্তুর মাত্রা (ক৩ = খ৩ (ক/খ) + গ৩ (ক/গ)) ঠিক রেখে আয়তন বের করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার প্রস্তাবিত সূত্রে কোসেক প এবং কোসেক ফ তো মূলত ‘ক’ এর ওপর নির্ভরশীল। তবে তিনি যদি ‘ক’ এর ওপর নির্ভর না করে কোনো ঘনকের জন্য উল্লিখিত সূত্রটি এভাবে ক৩ = খ৩+ গ৩ প্রমাণ করে দেখাতে পারতেন অথবা আরো উচ্চ ঘাতের জন্য তাহলে শুধু দেশে কেন পৃথিবীময় হয়ত সাড়া পড়ে যেত। যাক, তেমনটি হয়নি। 

আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সেমিনারের পরের দিন দেশের প্রায় সব জাতীয় পত্রিকার প্রথম নতুবা শেষ পৃষ্ঠায় এ কিউ চৌধুরীর সূত্রটি ফলাও করে ছাপানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভাগের সব শিক্ষকই তার কাজকে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার বলেছেন বলেও লেখা হয়েছে। আমরা আরো অবাক হলাম, সেমিনারে ফরমুলা উপস্থাপনের সময় ক্যামেরার এবং ভিডিওর আলোর ঝলকানিতে পিথাগোরাসের উপপাদ্য শুধু নয়, পুলিশ সুপার এ কিউ চৌধুরীর সূত্রটিও মাঝেমধ্যে জ্বলে যাচ্ছিল। 

সেমিনারটি আরো বিরক্তির হয়েছিল ক্যামেরাম্যানদের স্থান, দিক ও কোণ বদল করে বক্তার ছবি এবং তার প্রস্তাবিত সূত্রের ছবি ধারণের যন্ত্রণায়। পত্রিকার রিপোর্টগুলোতে সাংবাদিকরা এ কিউ চৌধুরীর প্রস্তাবিত সূত্রটি যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন ঠিকই কিন্তু প্রস্তাবিত ফরমুলা সম্বন্ধে শিক্ষকদের মতামতকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে-যা দুঃখজনক।

গণিত বিভাগের শিক্ষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকায় তার সূত্রের প্রতি যেভাবে সমর্থনের কথা বলা হয়েছে তা মোটেও উচিত হয়নি। পিথাগোরাস উপপাদ্য নিয়ে পুলিশ সুপার এ কিউ চৌধুরীর সূত্রটি হয়ত আমাদের মধ্যে ভুল বার্তা হিসেবে থেকে যাবে। তাই দেরিতে হলেও এ লেখার মাধ্যমে একটি প্রতিক্রিয়া জানালাম।

লেখক
অধ্যাপক, গণিত বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। 

সূত্র: ডেইলি-বাংলাদেশ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ