দেশের ঐতিহ্যের ধারক কারুশিল্প

নান্দনিকতা, উপযোগিতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় কারুশিল্প। একই সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন ও ব্যবহার উপযোগী হতে পারে এই শিল্প। অনেক ক্ষেত্রে তা ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে। মেশিনের পরিবর্তে হাতে তৈরি হওয়াই এই শিল্পের মূল বৈশিষ্ট্য।
স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে এটি মূলত তৈরি হয়। আমাদের দেশে কারুশিল্পের স্থানীয় উপাদান বাঁশ, কাঠ, মাটি, কাপড়, পাট ও ধাতু। নকশিকাঁথা, মাটির পাত্র বা খেলনা, পাটের তৈরি ব্যাগ বা চটের সামগ্রী, বাঁশ ও বেতের তৈরি ঝুড়ি, কাঠের খোদাই করা ফার্নিচার, জামদানি শাড়ি প্রভৃতি বাংলাদেশের কারুশিল্পের উদাহরণ। মানুষ যখন থেকে বাসস্থান, পোশাক ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে নিজ হাতে বিভিন্ন বস্তু তৈরি করা শুরু করে, তখন থেকেই কারুশিল্পের সূচনা।
এটি শুধু প্রয়োজন মেটানোর জন্যই নয়, বরং সৌন্দর্যবোধ ও সংস্কৃতির বিকাশের অংশ হিসেবেও গড়ে উঠেছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, চীন, ভারত ও গ্রিসে কারুশিল্প ছিল উচ্চমানের। ওই সময় মৃিশল্প, কাপড় বয়ন, ধাতব শিল্প, গয়না ইত্যাদি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশে কারুশিল্পের ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো।
সিন্ধু সভ্যতায় (মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা) উন্নত মৃিশল্প, ধাতবপাত্র, গয়না ও টেক্সটাইলের প্রমাণ পাওয়া যায়। মৌর্য, গুপ্ত ও মোগল যুগে কারুশিল্প রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়। মোগল আমলে জামদানি, মসলিন, হাতের কাজ করা পোশাক ও ধাতব কাজ বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে। বাংলার মসলিন, জামদানি ও নকশিকাঁথার ঐতিহ্য বিশ্ববিখ্যাত। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় কারুশিল্প অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে আবার নতুন করে কারুশিল্প চর্চা ও সংরক্ষণ শুরু হয়। বর্তমানে এটি একটি বড় হস্তশিল্প ও রপ্তানি খাত। বাংলাদেশের কারুশিল্প দেশের অর্থনীতিতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই শিল্প গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবিকার উৎস, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ও নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
বাঁশ, বেত, মাটি, পাট, কাঠ ইত্যাদি স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে এই শিল্পের পণ্য উত্পাদন করা হয়। ফলে স্থানীয় এই উপকরণগুলোরও অর্থনীতিক গুরুত্ব বাড়ে। কারুশিল্প খাতে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। যেমন—নকশিকাঁথা, জামদানি বয়ন ও পাটের কাজ। এটি গ্রামাঞ্চলের নারীদের ঘরে বসে আয়ের সুযোগ করে দেয়। জামদানি, পাটজাত পণ্য, নকশিকাঁথা, মৃিশল্প, কাঠ খোদাই ইত্যাদির কদর বহির্বিশ্বেও ব্যাপক। বাংলাদেশ লোক ও কারু শিল্প ফাউন্ডেশনের আয়োজনে প্রতিবছর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মাসব্যাপী ‘লোক ও কারুশিল্প মেলা’ বসে। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মেলায় কারুশিল্প প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হয়।
সূত্র: কালের কণ্ঠ