ইসলামিক জীবন
মহানবী (সা.) এর বিদায় হজ যেমন ছিল

ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানব, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পবিত্র জীবনের সর্বশেষ অধ্যায়গুলোর অন্যতম এক দিক হলো বিদায় হজ। এ হজ শুধু ইবাদত ছিল না, ছিল এক সর্বজনীন ঘোষণা, যার মাধ্যমে মানবতা,ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, ন্যায় ও তাওহিদের অমর বাণী ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সমগ্র বিশ্ববাসীর প্রতি।
বিদায় হজের পটভূমি
হিজরতের দশম বছর। ইসলাম তখন পরিপূর্ণ রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। আরবের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ওই বছর আল্লাহ তায়ালা নবী করিম (সা.)-কে হজ পালনের অনুমতি দিলেন। এই হজ-ই ছিল তার জীবনের প্রথম এবং শেষ হজ। এটি ইতিহাসে হুজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজ নামে খ্যাত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হজ পালনের ঘোষণা দেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার সাহাবি তার সঙ্গ লাভের সৌভাগ্য অর্জনে পবিত্র নগরী মক্কার দিকে রওনা হন।
হজযাত্রার সূচনা
মদীনাতুল মুনাওয়ারার কাছাকাছি জিলহজ মাসের ২৫ তারিখে (হিজরি ১০) রাসূলুল্লাহ (সা.) ৩১টি উট ও একটি ঘোড়াসহ সফরে রওয়ানা হন। তিনি মিকাতস্থ স্থান জুহফা-এর কাছে 'জুল-হুলাইফা' নামক স্থানে পৌঁছে ইহরাম বাঁধেন। ইহরামের পূর্বে তিনি গোসল করেন, সুগন্ধি ব্যবহার করেন এবং দু'রাকাত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা হজ্জান বলে হজের নিয়ত করেন।
মক্কায় প্রবেশ ও তাওয়াফ
মক্কায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম কাবা তাওয়াফ করেন, এরপর সাঈ করেন এবং কাবা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ দোয়া করেন। তিনি হজে কিরান পালন করেন, অর্থাৎ একইসাথে ওমরা ও হজ আদায় করেন।
আরাফার ময়দানে মানবতার ভাষণ
হজের মূল কার্যক্রম আরাফার দিন। হিজরি ১০ সনের ৯ই জিলহজ, আরাফার মহান দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়ালেন জাবালে রহমতের পাদদেশে। লাখো সাহাবির সম্মুখে তিনি একটি ভাষণ প্রদান করলেন যা ছিল মানব ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।
রাসূল (সা.) বললেন,
أيها الناس، إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام، كحرمة يومكم هذا، في شهركم هذا، في بلدكم هذا
হে মানুষ! তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও ইজ্জত পরস্পরের ওপর হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস ও এই শহরের পবিত্রতা হারাম। (সহীহ বুখারী: ১৭৩৯)
এ বক্তৃতায় তিনি নারী-পুরুষের সম্মান, নির্যাতনবিরোধিতা, সুদ-চক্রের অবসান, আমানত রক্ষা, গোঁড়ামি ও জাতপাতের বিভেদ দূর করার আহ্বান জানান। বললেন,
كلكم من آدم، وآدم من تراب، لا فضل لعربي على عجمي ولا لأعجمي على عربي إلا بالتقوى
তোমরা সবাই আদমের সন্তান, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। কোনো আরবের ওপর অনারবের, বা অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে।
আরও পড়ুন
দীনের পরিপূর্ণতা
এই বিদায় হজেই কোরআনের একটি কালজয়ী আয়াত নাজিল হয়, যা জানিয়ে দেয় যে ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে পূর্ণতা লাভ করেছে। বর্ণিত হয়েছে,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ، وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي، وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণতা দান করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা আল-মায়েদা, আয়াত : ৩)
এই আয়াত শোনার পর সাহাবিদের চোখে অশ্রু ঝরে পড়ে। তারা বুঝে নিয়েছিলেন, নবীজি (সা.)-এর বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
হজ শেষে নবীজির অন্তিম শিক্ষা
বিদায় হজের পরে মদীনায় ফিরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না। এর প্রায় ৮১ দিন পর, ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। এটাই ছিল তার পক্ষ থেকে উম্মতের প্রতি শেষ মহান শিক্ষা ও দায়িত্বের ঘোষণা।
বিদায় হজ শুধু একটি ইবাদত নয় ছিল নবুয়তের জীবন্ত সমাপ্তি, দ্বীনের পূর্ণতা এবং মানবজাতির কল্যাণের বার্তা। এই হজ আমাদের এক চিরন্তন শিক্ষা, মানবতা, ন্যায়, তাকওয়া এবং ইসলামের সার্বজনীনতার বার্তা দেয়।
বিদায় হজের ভাষণ ও শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গড়া সবার কর্তব্য। জাতিগত-ভাষাগত বিভেদ ভুলে ঐক্যের এক পতাকাতলে এসে দাঁড়াতে হবে, এবং রাসূল (সা.)-এর রেখে যাওয়া পথনির্দেশে জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আলোকিত করতে হবে।
সূত্র: ঢাকা পোষ্ট