বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৬:৩৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

৭১’রে ১৪ই ডিসেম্বর আমি হারালাম দুই ভাইকে …..?

৭১’রে ১৪ই ডিসেম্বর আমি হারালাম দুই ভাইকে …..?

৭১’রে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় আমি গাইবান্ধা কলেজের ডিগ্রীর ছাত্র। তাই ঐ সময়ের অনেক ঘটনাই আমি দেখেছি, অনেক ঘটনাই আমার জানা। আবার অনেক কিছুই হয়তো স্মৃতিতে নেই।
আমি এক বন্ধুর সাথে একাত্তরের ২৮ ফেব্র“য়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। আমরা জানতাম না ঐদিন বা আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের একটি মিছিল শহরে যাওয়ার সময় পাকসেনারা গুলি চালালে পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের এক ছাত্রসহ দুইজন মারা যায়। সেকারণে বন্ধুটি থাকতে চাইলেও আমরা রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার ঝুঁকি নিলাম না। আমরা বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে রাজশাহী রেলষ্টেশনে পৌছে গেলাম। আশুরার দিন হওয়ায় আমরা যাওয়ার সময় বিহারীদের তাজিয়া মিছিলের উদ্দাম চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। স্টেশনে গিয়ে আবার শুনলাম রাজশাহী শহরে কারফিউ জারি হয়েছে। আমাদের শংকা আরও বেড়ে গেল। তবুও রেলস্টেশন কারফিউয়ের আওতামুক্ত ভেবে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমনুরা থেকে আসা ট্রেনে দ্রুত উঠে পড়লাম। ট্রেনটা যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা অতিক্রম করছিল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক ছাত্রও ট্রেনে উঠে পড়লো। আব্দুলপুর জংশনে নেমে অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধবের দেখা পেলাম। ওদের কাছেই শুনলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়াবহ পরস্থিতির কথা। আরেকটা ট্রেনে উঠে সান্তাহার পৌঁছে প্লাটফর্ম বদলে একটা লোকাল ট্রেনে চড়লাম গাইবান্ধা যাওয়ার জন্য। কিন্তু গোটা দেশ তখন ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অর্ধদিবস হরতালের কারণে সোনাতলা রেলস্টেশনে ট্রেনটাকে আটকে দিল আন্দোলনকারীরা। দুপুরের পর ট্রেনটা ছেড়ে বিকেল ৪টার দিকে গাইবান্ধা স্টেশনে পৌঁছালো। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। স্টেশনে দেখলাম অনেক অভিভাবক উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর সন্তানকে খুঁজছেন। কারণ গতরাতে পাকসেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে আক্রমণ করায় কিছু ছাত্র নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সবাই তাদের স্বজনের খোঁজে ব্যস্ত।

দেখতে দেখতে সারা দেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। ঢাকার বাইরেও রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গোলমাল শুরু হলো। আর সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরতো গোটা জাতি যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিল। গাইবান্ধাতে ছাত্রজনতার মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। ২৩ মার্চ পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হলো গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন স্থানে। এরপর গাইবান্ধা কলেজ ও ইসলামিয়া স্কুল মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করলো ছাত্রযুবকরা। প্রতিরোধ করার একটা চেষ্টাও ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা শহরে পাকসেনারা প্রবেশ করলো। মাদারগঞ্জে ভারী যুদ্ধাস্ত্রসহ পাকবাহিনীর সামনে প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে আমাদের যোদ্ধারা পিছু হটলেন। আর বিকেলের মধ্যেই গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাকসেনারা গাইবান্ধা শহরে ঢুকে গেল। গুলির শব্দ শুনেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে শহরে থাকা আর নিরাপদ হবে না। আমাদের পরিবারের সবাই তখন থানাপাড়ায় আমাদের মামার বাড়ি অর্থাৎ গণেশ দা-দের বাড়িতেই থাকতাম। মামাতো ভাই পরেশ দা বললেন শহর থেকে একটু গ্রামের ভিতরে গোপালপুরে আমার পরিচিত এক পাটের ব্যাপারী আছে। সেখানে গেলে আমরা হয়তো নিরাপদে থাকতে পারবো। ঐদিন রাতেই আমরা দুই পরিবারের ৭জন পুরুষ, ৫ জন মহিলা ৩ শিশুসহ ১৫ জন পার্শ্ববর্তী রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের পোল্লাখাদা মৌজার যজ্ঞেশ্বর চন্দ্র সরকারের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। থানাপাড়ার বাসায় থাকলেন শুধু আমার নানা-নানী এবং এক প্রতিবন্ধী মামাতো ভাই। পরদিন সকালে আমার মেজদা কিশোরী, মামাতো ভাই গণেশ দা বললেন আমরা এখানে থাকবো না, যুদ্ধ করতে ইন্ডিয়া চলে যাব। সেই কথামত গণেশদা, কিশোরী দার সাথে মামাতো ভাই মতিলাল, বাবলু এবং যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ির যুবকরাও সদলবলে চলে গেল। আমরা অন্য ১১ জন থেকে গেলাম ঐ বাড়িতেই। আমার দাদা কেদারনাথ বললেন- আর্মিরা যখন এসেছে তখন ধীরে ধীরে দেশের সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কি অস্বাভাবিক বিশ্বাস! যে বিশ্বাসের খেসারত তাঁকে দিতে হলো জীবন দিয়ে।

২/৩ দিন পর থেকে শুনতে লাগলাম গাইবান্ধার বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট হচ্ছে। আমি খুব দুর্বল স্বাস্থ্যের হওয়ায় আমাকে দেখতে ছোটখাটো লাগতো। সেই সাহসে আমি গাইবান্ধা শহরের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে একদিন শহরে ঢুকলাম। পরিচিত একজনের সাথে দেখা হতেই বললেন তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে যাও। কারণ লুটপাট তো হচ্ছেই, হত্যাও করছে। এর মধ্যেই পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের ইঙ্গিতে জগৎ কর্মকার, মাতৃভান্ডারের দুই ভাই, আমার দাদার বন্ধু শ্যামল দা’কে হত্যা করেছে। আমি ফিরে গিয়ে সব জানালাম। কিন্তু আমরা যাব কোথায়, কীভাবে? কাছে তেমন টাকা পয়সাও নাই। আবার শুনতে পাচ্ছি ভারত যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা নানা স্থানে জীবন ভয়ে ভীত পলায়নপর মানুষের পথ আগলে সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে, নানাভাবে লাঞ্ছিত করছে। আমার বাবা তখন অন্নদানগর রেলস্টেশনে চাকুরি করতেন। তিনি পায়ে হেঁটে নানা দিক দিয়ে ঘুরে রামচন্দ্রপুরে আমাদের আশ্রয়স্থলে আসলেন। কিছু টাকা দিলেন। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না কীভাবে কোথায় যাব? কারণ তখন অবাঙালি আর রাজাকাররা খুবই তৎপরতা শুরু করেছে।

এভাবেই চলে এলো আমাদের পরিবারের জন্য সেই মর্মান্তিক দিনটি। ৩০ মে, ১৯৭১। মা আমাকে পাঠালেন গাইবান্ধার বাসায় কিছু জরুরী জিনিস আনতে। সাথে শিবু ও তার মাও ছিল। সেই সুবাদে অবশ্য আমি আজও বেঁচে আছি। আমরা শহরের এতিমখানার কাছে আসতেই দেখলাম পাক সেনাদের গাড়ী রামচন্দ্রপুরের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু তখনও ভাবিনি এরা যজ্ঞেশ্বর সরকারের বাড়িতেই যাচ্ছে। আমরা শহরে চলে এলাম। আর ঐদিকে পাকবাহিনী যজ্ঞেশ্বর বাবুর বাড়ির দিকে গেছে। আমাদের ধারণা ছিল সামনে দিয়ে ওরা আসলে আমরা ঐ বাড়ির পিছনের বিরাট বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে যেতে পারব। কিন্তু গোপালপুরের কামারের বাড়ির পাশ দিয়ে রাজাকার ও বিহারীরা আগে থেকেই ঘিরে ফেলেছিলো। পাকসেনারা যখন সামনের দিক দিয়ে যজ্ঞেশ্বর বাবুর

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ