শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ || ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রকাশিত : ১১:৩৫, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

গাইবান্ধায় এখনও নজর কারে লাঙ্গল-জোয়াল আর হালুয়া

গাইবান্ধায় এখনও  নজর কারে লাঙ্গল-জোয়াল আর হালুয়া
সংগৃহীত

একটা সময় লাঙল-গরুর হাল ছাড়া ফসলের জমি প্রস্তুতের কথা চিন্তাই করা যেত না। গ্রাম-গঞ্জে গরু কিংবা মহিষ দিয়ে হালচাষ করার রীতি প্রচলন ছিল। তবে কালের পরিক্রমায় ডিজিটালাইজেশনের যুগে নতুন চাষযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে গ্রামবাংলার গরু ও লাঙ্গলের সঙ্গে কৃষকের সেই মিতালীর দৃশ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। গরু দিয়ে এখন আর কৃষকদের জমি চাষ করতে দেখা যায় না। গরু দিয়ে হালচাষ। গরু-লাঙল নয় বরং ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এখন হালচাষ করা হয়।

কিন্তু কালের আবর্তে গরু-লাঙল হারিয়ে গেলেও গ্রামবাংলার এ অতীত ঐতিহ্যের চিত্র এখনো দেখা যায় উত্তরের জেলা গাইবান্ধার গ্রামগুলোতে। সাঘাটা উপজেলার টেপা পদুমশহর গ্রামের কৃষক মোসাদ্দিকুরসহ অনেকেই এখনও গরুর হালে তাদের জমি চাষ করেন। এ অঞ্চলে এখনও হারায়নি গরুর হালে চাষাবাদ, আছে লাঙ্গল-জোয়াল আর হালুয়া।

সময় বাঁচাতে কৃষক এখন ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে মাঠে গিয়ে জমি চাষ এবং যান্ত্রিক কায়দায় মই দিয়ে ফসল আবাদ করছেন। একটা সময় ছিল কৃষক গরু-লাঙ্গল ছাড়া জমি চাষ করার কথা চিন্তাই করতে পারতো না। লাঙ্গল-জোয়ালে গরু বেঁধে জমি চাষ আর মই দেওয়ার দৃশ্য সবার নজর কাড়তো, চলতো কৃষকের মাঝে হালচাষ ও মই দেওয়ার প্রতিযোগিতা। বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার গরু-লাঙ্গলের স্থান দখল করে নিয়েছে। আগে ঘন্টার পর ঘন্টা গরু দিয়ে হালচাষ এখন ট্রাক্টর দিয়ে নিমিষেই হয়ে যায়। কৃষক এখন তার সুবিধামত দিনের যে কোনও সময় ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে মাঠে গিয়ে অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় জমি চাষ এবং মই দিয়ে ফসল আবাদ করছেন।

গ্রাম বাংলার গরু-লাঙ্গলের সাথে কৃষকের সেই মিতালী দৃশ্য এখন ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসলেও শীতকালীন সবজি চাষাবাদ, নিচু জমি কিংবা যান্ত্রিক পরিবহন চলাচল ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে গাইবান্ধার কিছু কিছু এলাকার জমি চাষাবাদ করতে এখনও লাঙল আর জোয়ালের প্রয়োজন হচ্ছে। কারণ সবজি খেতে ট্রাক্টর দিয়ে হালচাষ করলে মই দিয়ে সমান করা যায় না। আবার জমিতে সারিবদ্ধভাবে চারা লাগাতে লাঙ্গলের ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে, নিচু জমিতে ভারী ওজনের ট্রাক্টর কাদায় দেবে যাওয়ায় কৃষক লাঙল দিয়ে চাষাবাদ করছেন।

শুক্রবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পদুমশহর ইউনিয়নের টেপা পদুমশহর গ্রামের কৃষক মোসাদ্দিকুর পৌনে তিন বিঘা জমি গরু দিয়ে হালচাষ করছেন। বাঁশের ফালা ও লোহা দিয়ে তৈরি করা ধারালো লাঙ্গল এবং জোয়ালের মাধ্যমে দুই গরুর কাঁধে বেঁধে দিয়ে জমিতে হাল চাষ করছেন চার পেশাদার হালুয়া (হালচাষী) আবুল কাশেম, মো. সাকি, আবুল ও আজিবর। তাদের ইশারায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছে লাঙ্গল-জোয়ালে বাঁধা চারজোড়া গরু।

কৃষক মোসাদ্দিকুর জানালেন, বছর দুয়েক আগে জমির মালিক আহম্মদ হাজীর কাছ থেকে জমিটি ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করছেন তিনি। এ বছর জমিতে সরিষার আবাদ করেছিলেন। ফসল ঘরে তোলার পর কিছুটা দেরিতে ইরি-বোরো আবাদের জন্য জমি প্রস্তুত করছেন তিনি। ইতোমধ্যে আশেপাশের জমিগুলোতে বোরো চারা রোপন করায় তার জমিতে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার নিয়ে যাওয়ার পথ নেই। তাই পৌনে তিন বিঘা জমি হাল এবং মই দিয়ে ইরি-বোরো আবাদের জন্য প্রস্তুত করার চুক্তিতে ২ হাজার ৪০০ টাকায় চারটি গরুর হাল ভাড়া করেন তিনি। সকাল আটটায় শুরু হয়ে দুপুর একটার মধ্যে জমি প্রস্তুত হওয়ার আশা করছেন তিনি।

হালচাষী (হালূয়া) মো. সাকি বলেন, পূর্বপুরুষের পেশা ছাড়েননি তিনি। স্থানীয়ভাবে আধূনিক যন্ত্র ট্রাক্টরের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরেও লাঙ্গল-গরু দিয়ে অন্যের জমি হালচাষ করে ভালো আয়-রোজগারও করছেন তিনি। আর যা রোজগার হচ্ছে তা নিয়ে তিনি সন্তুষ্টও। প্রতিদিন প্রায় তিন-চার বিঘা অন্যের জমি হালচাষ করেন।

কিছু কারণে কৃষক তার জমিতে লাঙ্গল-গরু দিয়ে হালচাষ করান বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন সাধারণত সবজি ক্ষেত এবং ছোট ছোট উঁচু-নিচু জমিতে লাঙল-গরুর হাল বেশি ব্যবহার হয়। ছোট ছোট জমি ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে পোষায় না। আবার ছোট জমির কারণে আবাদের সময় হেরফের হলে অন্যের জমি ব্যবহার করে ট্রাক্টর আসতেও পারে না। এতে আবাদবিহীন জমিতে ট্রাক্টর নিয়ে আসতে হলে আবাদ করা জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সে সময় লাঙ্গল-গরুই ফসলবিহীন জমির হালচাষ করার প্রধান হাতিয়ার। তিনি বলেন, ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষে পরিশ্রম এবং সময় কমেছে সত্যি। কিন্তু ফসলের গুণগতমান এবং স্বাদ কমে গেছে। তাছাড়া জমির উর্বরতাও হ্রাস পাচ্ছে। গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হয়, হাল চাষ করার সময় গরুর গোবর সেই জমিতে সারের কাজ করে।

বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও বাসদ মার্কসবাদী গাইবান্ধা জেলা আহবায়ক আহসানুল হাবীব সাঈদ বলেন, কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসন আর পাওয়ার টিলারের প্রচলন হওয়ায় গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে। কম সময়ে বেশি জমিতে চাষ দিতে সক্ষম হওয়ায় জমির মালিকরা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করে নিচ্ছেন। যেসব কৃষক গরু দিয়ে হাল চাষ করে জীবীকা নির্বাহ করতো তাদের বেশিরভাগই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তবে এখনো গ্রামের কিছু কৃষক জমি চাষের জন্য লাঙ্গল-জোয়াল, গরু আর মই দিয়ে চাষ পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেছেন।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ