শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ || ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রকাশিত : ১২:২৬, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

বিবেকানন্দকে নিজের স্কুলের চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছিলেন বিদ্যাসাগর

বিবেকানন্দকে নিজের স্কুলের চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছিলেন বিদ্যাসাগর
সংগৃহীত

স্বামী বিবেকানন্দের শ্রেষ্ঠত্বের কথা কম-বেশি সবারই জানা। সেই মহামানবের মহাপ্রয়াণের পরে কেটে গিয়েছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়। তবুও তার জীবন ও চিন্তাধারা এই সভ্যতার কাছে এক পরম পাথেয় হয়ে রয়েছে।

১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার সিমলায় জন্ম। ছোট থেকেই তার যুক্তিবিদ্যায় পারঙ্গমতা সকলকে মুগ্ধ করত। কিন্তু এত মেধা আর সম্ভাবনা নিয়েও সদ্য স্নাতক নরেনকে পড়তে হয়েছিল অকূল পাথারে। বাবা বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুর পরে ভয়াবহ অনিশ্চয়তার সামনে পড়তে হয়েছিল তাদের পরিবারকে। মা ও ভাইবোনদের গ্রাসাচ্ছেদনের ব্যবস্থা করতে একটা চাকরি তাই একান্তই দরকার হয়ে পড়েছিল।

বিএল পড়া থামিয়ে চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বছর একুশের নরেন। কিন্তু চাইলেই চাকরি দেয় কে? সেই সময়ও চাকরির বাজার ছিল প্রবল প্রতিযোগিতার। আর তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন নরেন। আগামী দিনে ভারতকে পথ দেখাবেন যিনি, তার চোখের সামনেই তখন গন্তব্যহীনতার অন্ধকার।

একদিকে রোজকার ডাল-ভাত, অন্যদিকে বাবার রেখে যাওয়া দেনা। দুইয়ের ধাক্কার পাশাপাশি আরেক বিপদ ঘরছাড়া হওয়া। বাবার এক কাকার করা মামলায় বাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে থাকতে হচ্ছে। কাজেই চাকরি একটা না হলেই নয়। এই তখনকার পরিস্থিতি।

এই অবস্থায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের বউবাজার শাখায় হেডমাস্টারি করার সুযোগ তাই নরেনের কাছে ঠিক কেমন ছিল তা বলাই বাহুল্য। তার আগে বহু অফিসে আবেদন করেও ফিরতে হয়েছে রিক্ত হাতে। রোজগারের তাড়নায় ইংরেজি বই অনুবাদও করতে হচ্ছিল। সেটা ১৮৮৪ সাল। পরবর্তী সময়ে ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ নামের এক মহাগ্রন্থ রচনা করে যিনি অমরত্ব লাভ করবেন, সেই ‘শ্রীম’ অর্থাৎ মহেন্দ্রনাথ গুপ্তর চেষ্টায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকরিটি পেয়ে গেলেন যুবক নরেন।

শ্রীম নিজেও ছিলেন ওই স্কুলের অন্য এক শাখার হেডমাস্টার। সদ্যই নরেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে দক্ষিণেশ্বরে। ১৮৮১ সালের নভেম্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল নরেনের। প্রথমে সিমলায় বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে। পরে দক্ষিণেশ্বরে। অচেনা ছেলেটির প্রতি প্রথম থেকেই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন রামকৃষ্ণ। তার কণ্ঠে ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ শোনার পরে যে মুগ্ধতার সূচনা। নরেন তখন ঈশ্বরচিন্তায় বিভোর। কিন্তু ১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবার প্রয়াণে সংসার চিন্তায় বিঘ্ন ঘটল তার সেই আধ্যাত্মিক চিন্তায়। দিন গুজরানই তখন বড় বালাই। মেট্রোপলিটনের চাকরি যেন সেই বিপদের মুখে বড় আশ্বাস হয়ে দেখা দিল।

যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে নরেনের সুদিন এতেও ফেরেনি। কেননা চাকরিটা বেশিদিন টেকেনি। ফের কর্মহীন হতে হয়েছিল তাঁকে। আসলে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরেক মহামানবের নাম। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। উজ্জ্বল চোখের যুবক নরেনকে তার বেশ পছন্দই ছিল বলে জানা যায়। সেই তিনিই জানিয়ে দিলেন, ‘নরেনকে বলে দিও ওকে আর আসতে হবে না।’ কিন্তু কেন এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন বিদ্যাসাগর?

ঠিক কী হয়েছিল তা নিয়ে নানা মত আছে। একটা মত বলছে, বরখাস্ত করা হয়নি বিবেকানন্দকে। স্কুলের সেক্রেটারি সূর্যকুমার অধিকারীর চাপে পড়ে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কেননা পারিবারিক যে মামলা মোকদ্দমার কথা আগেই বলা হয়েছে, তার ধাক্কায় মাঝেমধ্যেই আদালতে ছুটতে হত নরেনকে। এই অনিয়মিত হয়ে পড়ার কারণেই নাকি তিনি চক্ষুশূল হয়ে পড়েছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ তথা বিদ্যাসাগরের। আর তাই অচিরেই শ্বশুরমশাইয়ের অনুমতি নিয়েই প্রধান শিক্ষককে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেন সূর্যকুমার।

এই ঘটনারই আরেকটি রূপ রয়েছে। এমনও জানা যায়, নতুন শিক্ষক স্কুলে এসে পড়াশোনার পাশাপাশি পড়ুয়াদের গানবাজনা শেখা কিংবা খেলাধুলো করারও উৎসাহ দিতেন। এটা মোটেই ভালোভাবে নেননি সূর্যকুমার। ফলে অচিরেই তিনি শ্বশুরমশাইয়ের কানভারী করেন। সেই সময় বিদ্যাসাগর পেটের অসুখে জেরবারও ছিলেন। মনটা ছিল অপ্রসন্ন। নিজের বক্তব্যকে মজবুত করতে স্কুলের ছাত্রদের দিয়েও সাক্ষ্য দিইয়েছিলেন সেক্রেটারি। এসব শুনতে শুনতেই নাকি বিরক্ত হয়ে বিদ্যাসাগর সিদ্ধান্ত নেন, নরেনকে আর স্কুলে রাখার মানে হয় না।

ঠিক যাই ঘটে থাকুক, বিদ্যাসাগরের স্কুলে মাসখানেকের বেশি থাকা হয়নি বিবেকানন্দের। আর এটা বিদ্যাসাগরের অজানা ছিল না। তিনি সেভাবে যাচাই না করেই সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন নরেনের প্রস্থানে। এই কারণেই সম্ভবত দুজনের মধ্যে কোনো সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

যাই হোক, জীবন সেই সময় এক বিরাট পরীক্ষা নিয়েছিল নরেনের। মনোবল হারাতে থাকা বন্ধুকে সুরা ও নারীর ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল বন্ধুরা। এক বাগানবাড়িতে দেহপসারিণী রমণীকে প্রশ্নবাণে বেসামাল করে দিয়েছিলেন নরেন। তার দরদি প্রশ্নমালার সামনে পড়ে কার্যতই পিঠটান দিতে হয়েছিল সেই নারীকে। বন্ধুদের ‘উদ্দেশ্য’ সফল হয়নি। নিজের ব্যক্তিত্বের আঁচে অন্তরাত্মাকে একই রকম আলোকিত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন বিবেকানন্দ।

 

সূত্র: ডেইলি-বাংলাদেশ

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ