বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২১ মে ২০২৩

পবিত্র কোরআন-হাদিসে মৌমাছির বর্ণনায় যা বলা আছে

পবিত্র কোরআন-হাদিসে মৌমাছির বর্ণনায় যা বলা আছে

মৌমাছি আমাদের জন্য উৎকৃষ্ট মধু আহরণ করে। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মধু খেতে খুব ভালোবাসতেন। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস: ১২১) মৌমাছিরা দেখতে খুব ছোট একটি প্রাণী। তবে এরা খুবই পরিশ্রমী হয়। পবিত্র কোরআনে এই প্রাণীকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, তোমরা ফুলের কাছে চলে যাও। মৌমাছিরা আল্লাহর আদেশ মেনে নিজেদের পছন্দমতো ফুলের কাছে যায়। সেখান থেকে ফুলের নির্যাস চুষে নিয়ে আসে। কিন্তু ফুলের কোনো ক্ষতি করে না। ফুলের নির্যাস এমনভাবে চুষে নিয়ে আসে যে, আধুনিক যুগের কোনো মেশিনও এমনভাবে পারে না। এটা সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ ক্ষুদ্র প্রাণীটির মধ্যে সেই শক্তি দিয়েছেন। যারা ওখান থেকে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। যা মৌমাছির পেটে যাওয়ার পর মধু হয়ে যায়। বিভিন্ন রঙের ফুল-ফল থেকে তারা যে নির্যাস বের করে তা অঞ্চলভেদে একেক রকম হয়ে থাকে। যেমন- সরিষা থেকে নিলে এক রকম রং হয়, সুন্দরবনের মধুর আরেক রকম রং হয়। অর্থাৎ ফুল আর ফলভেদে এর রঙেও ভিন্নতা থাকে। আপনারা জানেন, মৌমাছির হুলে বিষ থাকে। এটা আশ্চর্যজনক বিষয় যে, বিষাক্ত একটা পোকা যার মাধ্যমে এত সুন্দর একটা পানীয় আল্লাহ তাআলা আমাদের বের করে খাওয়াচ্ছেন। যা ফল-ফুলের নির্যাস থেকে বের করে আনার পর মানুষের  উপকারী খাবারে পরিণত হচ্ছে...।

পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুর আলামিন কঠিন কিছু বিষয়কে সহজ করে বোঝানোর জন্য কিছু উপমা দিয়েছেন। সেসব উপমার মাধ্যমে আমাদের কিছু জিনিসকে স্পষ্ট এবং সহজ করে বুঝিয়েছেন। তেমনি কিছু বিষয়কে উপস্থাপন করার জন্য আল্লাহ মৌমাছির উপমা দিয়েছেন। কোরআনুল কারিমের ওই মৌমাছির বর্ণনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি, জানতে পারি।

বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবিদের বিভিন্ন বিষয়ে উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। পরকালের ভয়ঙ্কর শাস্তির দৃশ্যকে তিনি উপমার মাধ্যমে চিত্রায়িত করেছেন। এমন কিছু বিষয়ে তিনি উপমা দিয়েছেন, যেগুলো নিয়ে বর্ণনা করলে ঈমান অনেক ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হয়।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘ওই সত্তার শপথ, যার পবিত্র হাতে মোহাম্মাদ (সা.) এর জীবন। নিশ্চয়ই ঈমানদাররা হলো মৌমাছির মতো। যারা উত্তম জিনিস খায়, উত্তম জিনিস তার পেট থেকে বের হয়। তারা ফুলের ওপর বসে, কিন্তু তা নষ্ট করে না কিংবা ভেঙে ফেলে না’। (মুসনাদে আহমদ,হাদিস নম্বর ৬৮৭২)

মৌমাছির দৃষ্টান্ত কিন্তু রাসূলে করিম (সা.) মুসনাদে আহমদের এই হাদিসে বর্ণনা করেছেন। কোরআনুল কারিমেও মৌমাছির বর্ণনা এসেছে। মৌমাছি সাধারণত সরদারের অনুসরণ করে থাকে। উৎকৃষ্ট জিনিস তারা আহরণ করে থাকে। কোনো কিছুর ক্ষতি তারা করে না এবং সব সময় পরিশ্রম করে থাকে। অর্থাৎ কর্ম উদ্যম। আরেকটি হলো, আমানতদারিতা। এ কয়টা জিনিস তারা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে দেয়। মৌমাছির বর্ণনা থেকে আমরা আর কী কী শিখব সেসব গুরুত্বপূর্ণ।

এটি এমন একটি সূক্ষ্ম বিষয়, যেটা নিয়ে মানুষ সাধারণত কথা বলে না। এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কোরআন এবং হাদিসের আলোকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলো-

আল্লাহ মৌমাছিকে একটি বিশেষ জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যেটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এ জন্য রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা মৌমাছির নামে একটি সূরা বর্ণিত করেছেন। সুরাটির নাম হলো সূরাতুন নাহল। আরবি নাহল শব্দের বাংলা অর্থ মৌমাছি। এই সূরাটি পবিত্র কোরআনের ১৬তম সূরা। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ১২৮টি। এই সূরার ৬৮ আয়াতের থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এর একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এই সূরাটির মধ্যে আল্লাহপাক ৬৮ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন- وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ
অর্থ: ‘আপনার পালনকর্তা মধু মক্ষিকাকে আদেশ দিলেন: পর্বতগাহ্রে, বৃক্ষ এবং উঁচু চালে গৃহ তৈরি কর’। এটা আল্লাহপাক মৌমাছিকে আদেশ করেছেন। 

আল্লাহপাক ৬৯ নম্বর আয়াতে আরো বলেছেন-  ثُمَّ كُلِي مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلاً يَخْرُجُ مِن بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاء لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থ: ‘এরপর সব প্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে’। (সূরা: নাহল, আয়াত: ৬৯)

মধু হচ্ছে  ওষুধ এবং খাদ্য উভয়ই। মধুকে বলা হয়- বিররে এলাহি ও তিব্বে নব্বী। অর্থাৎ খোদায়ী চিকিৎসা ও নবী করিম (সা.) এর বিধানের অন্তর্ভুক্ত। সূরা মুহাম্মদ এর ১৫ আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ করেছেন, ‘জান্নাতে স্বচ্ছ মধুর নহর প্রবাহিত হবে’।

মধু সাধারণত তরল আকারে থাকে তাই একে পানীয় বলা হয়। মধু যেমন বলকারক খাদ্য এবং রসনার জন্য আনন্দ ও তৃপ্তিদায়ক, তেমনি রোগ ব্যাধির জন্যও ফলদায়ক ব্যবস্থাপত্র। কেন হবে না, স্রষ্টার ভ্রাম্যমাণ মেশিন সর্বপ্রকার ফল-ফুল থেকে বলকারক রস ও পবিত্র নির্যাস বের করে সুরক্ষিত গৃহে সঞ্চিত রাখে।

মধুর আরো একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, নিজেও নষ্ট হয় না এবং অন্যান্য বস্তুকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত নষ্ট হতে দেয় না। এ কারণেই হাজারো বছর ধরে চিকিৎসকরা একে অ্যালকোহল এর স্থলে ব্যবহার করে আসছেন। মধু বিরেচক এবং পেট থেকে দূষিত পদার্থ অপসারক।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে কোনো এক সাহাবি তার ভাইয়ের অসুখের বিবরণ দিলে তিনি তাকে মধু পান করানোর পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় দিনও এসে আবার সাহাবি বললেন- অসুখ বহাল রয়েছে। তিনি আবারো একই পরামর্শ দিলেন। তৃতীয় দিনও যখন সংবাদ এল যে, অসুখের কোনো পার্থক্য হয়নি, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহর উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। উদ্দেশ্য এই যে, ওষুধের কোনো দোষ নেই। রোগীর বিশেষ মেজাজের কারণে ওষুধ দ্রুত কাজ করেনি। এরপর রোগীকে আবার মধু পান করানো হয় এবং সে সুস্থ হয়ে উঠে।

মধুর নিরাময় শক্তি বিরাট ও সতন্ত্র ধরনের। কিছু সংখ্যক আল্লাহ ওয়ালা বুজর্গ ব্যক্তি এমনো রয়েছেন, যারা মধু সব রোগের প্রতিষেধক হওয়ার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। তারা ফোঁড়া ও চোখের চিকিৎসাও মধুর মাধ্যমে করেন। দেহের অন্যান্য রোগেরও চিকিৎসা মধুর দ্বারা করেন। 

হজরত ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তার শরীরে ফোঁড়া বের হলেও তিনি তাতে মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কি বলেননি যে, তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। (কুরতুবী)

কোরআন আরো বলেছে মধুর ওষুধিগুণের কথা। আজ আমরা জেনেছি মধুর মধ্যে রয়েছে প্রচুর খাদ্যগুণ, আছে প্রচুর ভিটামিন কে আর ফ্রুক্টোজ। আরো আছে মাঝারি এন্টিসেপ্টিক গুণ। কেটে যাওয়া বা পুড়ে যাওয়া যায়গায় মধু লাগিয়ে রাখলে কোনো রকম ইফেকশান হয় না। বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বালা পোড়া ভাব কমে যায়।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ