শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১২:৫৬, ১৩ জানুয়ারি ২০২২

শক্তিশালী আদ জাতি যে কারণে ধ্বংস হয়েছিল

শক্তিশালী আদ জাতি যে কারণে ধ্বংস হয়েছিল

একটি নির্দেশ অমান্য করেই শক্তিশালী আদজাতি মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো! কার নির্দেশ অমান্য করেছিল এই জাতি? আর কী নির্দেশই বা তারা অমান্য করেছিল? কোরআনে আদজাতি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে? ইতিহাসের শক্তিশালী গোত্রগুলোর মধ্যে একটি ছিল আদ গোত্র। মাত্র ১৩ পরিবারের গোত্র হলেও ব্যাপক এলাকাজুড়ে ছিল তাদের অবস্থান। তাদের বসতি ছিল আম্মান থেকে শুরু করে হাজরামাউত ও ইয়ামান পর্যন্ত।

সে সময়ের অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামলে ভরপুর ছিল তাদের তাদের খেত-খামার। সব ধরনের বাগ-বাগিচাও ছিল তাদের। তাদের দৈহিক গঠন ও শক্তি-সাহসের কারণে অন্য সবার চেয়ে তারা ছিল স্বতন্ত্র এক জাতি। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে তাদের এ বিষয়গুলো ওঠে এসেছে-

اَلَمۡ تَرَ کَیۡفَ فَعَلَ رَبُّکَ بِعَادٍ - اِرَمَ ذَاتِ الۡعِمَادِ - الَّتِیۡ لَمۡ یُخۡلَقۡ مِثۡلُهَا فِی الۡبِلَادِ

তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক আদ জাতির সঙ্গে কিরূপ আচরণ করেছিলেন; সুদীর্ঘ দেহের অধিকারী ইরাম (আদ) গোত্রের সঙ্গে? যার সমতুল্য (এমন দীর্ঘকায় ও শক্তিশালী) জাতি এর আগে অন্য কোনো দেশে (পৃথিবীতে) সৃষ্টি হয়নি।’ (সুরা ফজর : আয়াত ৬-৮)

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং মুকাতিল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাদের সৃষ্টি সম্পর্কে একটি ইসরায়েলি বর্ণনা এভাবে তুলে ধরেছেন যে, ‘তাদের উচ্চতা ছিল ১৮ ফুট (১২ হাত)।

আদ জাতির প্রতি আল্লাহর নির্দেশ

অন্য আয়াতে কাওমে নুহের পর তাদের প্রতি করণীয় প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা আরো ঘোষণা করেন-

اَوَ عَجِبۡتُمۡ اَنۡ جَآءَکُمۡ ذِکۡرٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ عَلٰی رَجُلٍ مِّنۡکُمۡ لِیُنۡذِرَکُمۡ ؕ وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ جَعَلَکُمۡ خُلَفَآءَ مِنۡۢ بَعۡدِ قَوۡمِ نُوۡحٍ وَّ زَادَکُمۡ فِی الۡخَلۡقِ بَصۜۡطَۃً ۚ فَاذۡکُرُوۡۤا اٰلَآءَ اللّٰهِ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

‘তোমরা কি আশ্চর্যবোধ করছ যে, তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে; যাতে সে তোমাদের সতর্ক করে? স্মরণ কর! আল্লাহ তোমাদেরকে নুহের সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের (আদ জাতির) অবয়ব ও শক্তিতে (অন্য লোক অপেক্ষা অধিকতর) সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৬৯)

হজরত নুহ আলাইহিস সালামের পর আল্লাহ তাআলা আদ জাতির কাছে হজরত হুদ আলাইহিস সালামকে ‍দিকনির্দেশনাসহ নবি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ ঘোষণা দেন-

وَ اِلٰی عَادٍ اَخَاهُمۡ هُوۡدًا ؕ قَالَ یٰقَوۡمِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرُهٗ ؕ اَفَلَا تَتَّقُوۡنَ

‘আদ জাতির কাছে ওদের ভাই হুদকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা (কেবল) আল্লাহর উপাসনা কর। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো (সত্যিকার) উপাস্য নেই, তোমরা কি সাবধান হবে না?’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৬৫)

আয়াতে ঘোষিত এই আদ সম্প্রদায় হল প্রথম আদ। যাদের বাসস্থান ইয়ামানের বালুময় পাহাড়ে ছিল। আর শক্তি-সামর্থ্যে তারা ছিল অতুলনীয়। তাদের নিকট হুদ আলাইহিস সালাম নবি হয়ে এসেছিলেন; যিনি তাদেরই মধ্যেকার একজন ছিলেন।

আদ জাতির ধ্বংসের কারণ

এই আদ জাতি ছিল মূর্তিপূজারী। মূর্তিপূজাসহ তারা আরো নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। হজরত হুদ আলাইহিস সালাম তাদের মূর্তিপূজা ছেড়ে আল্লাহর একত্ববাদের অনুসরণ করতে এবং সব ধরনের অত্যাচার-উত্পীড়ন বর্জন করে ন্যায় ও সুবিচারের পথ ধরতে বলেছিলেন। কিন্তু তারা নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে নিমজ্জিত হয়ে তাঁর (হুদ আলাইহস সালাম) আদেশ অমান্য করে। সুরা আরাফে তা ধারাবাহিকভাবে ওঠে এসেছে এভাবে-

قَالَ الۡمَلَاُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ قَوۡمِهٖۤ اِنَّا لَنَرٰىکَ فِیۡ سَفَاهَۃٍ وَّ اِنَّا لَنَظُنُّکَ مِنَ الۡکٰذِبِیۡنَ

‘তার সম্প্রদায়ের প্রধানগণ যারা অবিশ্বাস করেছিল, তারা বলেছিল, ‘আমরা তো দেখছি তুমি একজন নির্বোধ এবং তোমাকে আমরা তো একজন মিথ্যাবাদী মনে করি।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৬৬)

قَالَ یٰقَوۡمِ لَیۡسَ بِیۡ سَفَاهَۃٌ وَّ لٰکِنِّیۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ

‘সে (হুদ আলাইহিস সালাম) বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমি নির্বোধ নই, আমি তো বিশ্ব-জগতের প্রতিপালকের (প্রেরিত) একজন রাসুল।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৬৭)

اُبَلِّغُکُمۡ رِسٰلٰتِ رَبِّیۡ وَ اَنَا لَکُمۡ نَاصِحٌ اَمِیۡنٌ

‘আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের জন্য একজন বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্ক্ষী (উপদেষ্টা)।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৬৮)

اَوَ عَجِبۡتُمۡ اَنۡ جَآءَکُمۡ ذِکۡرٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ عَلٰی رَجُلٍ مِّنۡکُمۡ لِیُنۡذِرَکُمۡ ؕ وَ اذۡکُرُوۡۤا اِذۡ جَعَلَکُمۡ خُلَفَآءَ مِنۡۢ بَعۡدِ قَوۡمِ نُوۡحٍ وَّ زَادَکُمۡ فِی الۡخَلۡقِ بَصۜۡطَۃً ۚ فَاذۡکُرُوۡۤا اٰلَآءَ اللّٰهِ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ

‘তোমরা কি আশ্চর্যবোধ করছ যে, তোমাদেরই একজনের মাধ্যমে তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে; যাতে সে তোমাদের সতর্ক করে? স্মরণ কর! আল্লাহ তোমাদেরকে নুহের সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের (আদ জাতির) অবয়ব ও শক্তিতে (অন্য লোক অপেক্ষা অধিকতর) সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৬৯)

قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا لِنَعۡبُدَ اللّٰهَ وَحۡدَهٗ وَ نَذَرَ مَا کَانَ یَعۡبُدُ اٰبَآؤُنَا ۚ فَاۡتِنَا بِمَا تَعِدُنَاۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ

‘তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের নিকট এ উদ্দেশ্যে এসেছে যে, আমরা যেন শুধু আল্লাহর উপাসনা করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ যার উপাসনা করতো তা বর্জন করি? সুতরাং তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যে (আযাবের) ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর।’  (সুরা আরাফ : আয়াত ৭০)

এরপর আদ জাতির প্রতি শাস্তি...

আদ জাতি তাদের নবি হজরত হুদ আলাইহিস সালামের কথা অমান্য করে পাপাচারে লিপ্ত থাকার কারণে আল্লাহ তাআলা আদ জাতিকে ধ্বংস করে দেন। তাদের প্রতি প্রথম আজাব ছিল অনাবৃষ্টি। তিন বছর তাদের এলাকায় বৃষ্টি বন্ধ ছিল।

এতে তাদের সব ফসল জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। ফলে দেশে অভাব দেখা দেয়। এরপরও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। তারপর আট দিন সাত রাত তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়। এতে তাদের বাড়ি-ঘর, বাগ-বাগিচা, জীবজন্তু সব ধ্বংস হয়ে যায়। তারা নিজেরাও শূন্যে উড়তে থাকে। রাতে তারা মরে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

قَالَ قَدۡ وَقَعَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ رِجۡسٌ وَّ غَضَبٌ ؕ اَتُجَادِلُوۡنَنِیۡ فِیۡۤ اَسۡمَآءٍ سَمَّیۡتُمُوۡهَاۤ اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمۡ مَّا نَزَّلَ اللّٰهُ بِهَا مِنۡ سُلۡطٰنٍ ؕ فَانۡتَظِرُوۡۤا اِنِّیۡ مَعَکُمۡ مِّنَ الۡمُنۡتَظِرِیۡنَ

‘(হুদ) বলল, ‘তোমাদের প্রতিপালকের শাস্তি ও ক্রোধ তো তোমাদের উপর নির্ধারিত হয়েই আছে, তবে কি তোমরা আমার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও এমন কতকগুলি নাম সম্বন্ধে, যার নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা করেছে এবং সে সম্বন্ধে আল্লাহ কোনো সনদ (স্বীকৃতি) পাঠাননি? সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছি।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৭১)

আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘তোমরা কাউকে বৃষ্টির দেবতা, কাউকে বায়ুর দেবতা, কাউকে ধন-সম্পদের দেবতা, আবার কাউকে রোগের দেবতা বলে থাকো। অথচ তাদের কেউ মূলত কোনো জিনিসের স্রষ্টা ও প্রতিপালক নয়।

মানুষের জন্য আরও সতর্কতা যে-

বর্তমান যুগেও এসবের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। এ যুগেও লোকেরা কাউকে বিপদ মোচনকারী বলে থাকে। অথচ বিপদ থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতাই তার নেই। লোকেরা কাউকে গনজ বখশ (গুপ্ত ধন ভান্ডার দানকারী) বলে অভিহিত করে থাকে। অথচ তার কাছে কাউকে দান করার মত কোনো ধনভান্ডার নেই।

কাউকে ‘গরীব নওয়াজ’ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। অথচ তিনি নিজেই গরীব। যে ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ফলে কোনো গরীবকে প্রতিপালন ও তার প্রতি অনুগ্রহ করা যেতে পারে সেই ধরনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে তার কোনো অংশই নেই।

আবার কাউকে ‘গাউস’ (ফরিয়াদ শ্রবণকারী) বলা হয় অথচ কারোর ফরিয়াদ শোনার এবং তার প্রতিকার করার কোনো ক্ষমতাই তার নেই। কাজেই এ ধরনের যাবতীয় নাম বা উপাধি নিছক নাম বা উপাধি ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ নামগুলোর পেছনে কোনো সত্তা বা ব্যক্তিত্ব নেই। যারা এগুলো নিয়ে ঝগড়া ও বিতর্ক করে তারা আসলে কোনো বাস্তব জিনিসের জন্য নয়, বরং কেবল কতিপয় নামের জন্যই ঝগড়া ও বিতর্ক করে।

আদ জাতির প্রতি আল্লাহ আজাব প্রেরণ…

মহান আল্লাহ তাআলা হজরত নুহ আলাইহিস সালামের পর হজরত হুদ আলাইহিস সালামের বিরোধিতাকারীরা তাঁকে অস্বীকার করে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। যার ফলে মহান আল্লাহ পৃথিবীর সেরা শক্তিধর আদ জাতিকে এভাবে ধ্বংস করেন। আর হুদ আলাইহিস সালাম ও তাঁর অনুসারী মুমিনদের এসব আজাব থেকে রক্ষা করেন। আজও আদ জাতির এলাকা মরুভূমি আর মরুভূমিতে পরিণত হয়ে আছে। এ কথাটি আল্লাহ তাআলা এভাবে তুলে ধরেন-

فَاَنۡجَیۡنٰهُ وَ الَّذِیۡنَ مَعَهٗ بِرَحۡمَۃٍ مِّنَّا وَ قَطَعۡنَا دَابِرَ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا وَ مَا کَانُوۡا مُؤۡمِنِیۡنَ

‘এরপর তাকে (হুদ আলাইহিস সালাম) ও তার সঙ্গীদেরকে আমার দয়াতে উদ্ধার করেছিলাম এবং আমার নিদর্শনসমূহকে যারা (আদ জাতি) মিথ্যা মনে করেছিল এবং যারা অবিশ্বাসী ছিল তাদেরকে নির্মূল (ধ্বংস) করেছিলাম।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৭২)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে আদ জাতির ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করে দুনিয়া ও পরকালের সুনিশ্চিত সফলতা পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ