সাজসজ্জায় ইসলামের নির্দেশনা
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরতম সৃষ্টি হল মানুষ, যাকে আল্লাহ তায়ালা উত্তম গঠন, সুন্দর অবয়ব ও সুষম আকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন। যিনি তোমাকে তার ইচ্ছামতো আকৃতিতে গঠন করেছেন।’ (সুরা ইনফিতার : ৭-৮)।
স্বভাবতই সাজসজ্জার প্রতি মানুষের মন ধাবিত হয়। সাজসজ্জা মানুষের স্বভাবজাত বিষয় এবং নেয়ামত ও প্রমোদের বস্তু। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদিপশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর কাছেই হলো উত্তম আশ্রয়।’ (আলে ইমরান : ১৪)। উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে দ্বীনের মহত্ত্ব ফুটে উঠেছে। ইসলাম ধর্ম মানুষের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেছে এবং প্রকৃতগত চাহিদা পূরণে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের জন্য যে উপকরণ সুসজ্জিত করেছেন তা উপভোগ করার অনুমতি দিয়ে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আপনি বলুন আল্লাহর সাজসজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুগুলোকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুন, এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মোমিনদের জন্য এবং কেয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্য। এমনিভাবে আমি আয়াতগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্য যারা বুঝে। (সুরা আরাফ : ৩২)।
প্রিয় নবীজী (সা.) নিজে ছিলেন সুন্দর এবং সৌন্দর্যবোধ ছিল তার ভূষণের অন্তর্ভুক্ত। তার সৌন্দর্যধারণ হতো কৃত্রিমতামুক্ত। সাজসজ্জা ছিল অপচয়হীন। তিনি খ্যাতিবর্জিত মার্জিত পোশাক পরতেন। নিজের ঘন দাড়ি চিরুনি করতেন। বাহ্যিক পরিপাটির ব্যাপারে সচেতন থাকতেন। যখন কোনো প্রতিনিধি দল আসত, সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরতেন। বারা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (সা.) কে একজোড়া লাল পোশাক পরা অবস্থায় দেখেছি। তার চেয়ে অধিক সুন্দর আর কিছু আমি দেখিনি।’ (বোখারি)।
পরিমিত সাজসজ্জার ব্যাপারে রাসূল (সা.) হলেন উত্তম আদর্শ। তিনি সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার অভ্যাস ছিল, তিনি কখনও সুগন্ধি ফেরত দিতেন না বরং বেশি বেশি সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। আতরের সৌরভে সুবাসিত হতেন। তিনি বলেছেন, কারও কাছে কোনো ফুল আনা হলে, সে যেন তা ফিরিয়ে না দেয়। কারণ তা ওজনে হালকা এবং ঘ্রাণে উত্তম। (মুসলিম)।
একজন মুসলমান বিভিন্ন স্থান ও অবস্থার আলোকে মানানসই ও উপযুক্ত সাজসজ্জা গ্রহণ করে থাকে। আর তার মনে এ বিষয় সংশয় সৃষ্টি করে না যে সাজসজ্জা গ্রহণের জন্য সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো আল্লাহর ঘর তথা মসজিদগুলো। কারণ মসজিদই সবচেয়ে পবিত্র ও আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে বনি আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।
হাসান বিন আলী (রা.) যখন মসজিদের জন্য বের হতেন সবচেয়ে সুন্দর ও দামি পোশাক পরিধান করতেন। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। তাই আমি রবের জন্য সৌন্দর্য গ্রহণ করেছি। আর তিনি তো বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।
মুসলমান নিজ ব্যক্তিত্ব, অবস্থান, মর্যাদা এবং পারিপার্শ্বিকতর প্রতি লক্ষ্য রেখে বেশভূষা গ্রহণ করবে। মালেক বিন নাদরাতা জুশামি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নিম্নমানের কাপড় পরে নবী (সা.) এর কাছে গেলে তিনি তাকে বললেন, তোমার ধন-সম্পদ আছে কী? তিনি বললেন, জ্বি হ্যাঁ, প্রত্যেক রকমের মালই আমার রয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন কী মাল আছে? তিনি বলেন : আল্লাহ তায়ালা আমাকে উট, বকরি, ঘোড়া এবং গোলাম দান করেছেন। নবী (সা.) বললেন : যখন আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দান করেছেন, তখন আল্লাহর রহমত ও দানের চিহ্ন তোমার মধ্যে বাহ্যিকভাবেও প্রকাশ পাওয়া উচিত। (নাসায়ি)।
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এর নির্দেশনা হলো, সাজসজ্জায় দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যত্নের পাশাপাশি বাহ্যিক পরিপাটি ও সৌন্দর্যকে অন্তর্ভুক্ত করা। নবীজি এলোকেশি এক জীর্ণশীর্ণ লোককে দেখে বললেন, এ লোকটা কি চুল পরিপাটি করার কিছু পায় না? ময়লা কাপড় পরিহিত এক লোককে দেখে বললেন এ লোকটা কি কাপড় পরিষ্কার করার কিছু পায় না? রাসুল (সা.) বলেছেন, যার চুল আছে, সে যেন এর যত্ন নেয়।
মক্কা বিজয়ের দিনে আবু কুহাফাহ (রা.) কে নিয়ে আসা হলো; তার চুল-দাড়ি ছিল ‘সাগামা’র মতো শুভ্র। সে সময় রাসূল (সা.) বললেন, ‘একে একটা কিছু দিয়ে পাল্টে দাও; তবে কালো রং থেকে বিরত থাকবে।’ (মুসলিম)। পারিবারিক পরিবেশে সৌন্দর্য এবং পরিপাটি থাকার অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। বৈবাহিক জীবনের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক ঘনিষ্ঠতা পাকাপোক্ত রাখতে পরিপাটি থাকার অত্যধিক প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের ওপর নিয়ম অনুযায়ী। (সুরা বাকারা : ২২৮)। এমনকি ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটি হয়ে থাকি, যেরূপ আমি পছন্দ করি যে সেও আমার জন্য সাজসজ্জা গ্রহণ করুক।’
রূপচর্চা ও সাজসজ্জা বলতে কী বোঝায়, ইসলাম এর ভাবার্থ মার্জিত ও শিষ্টাচারের আওতায় শিক্ষা দিয়েছে। এ বিষয়ে যাবতীয় অস্পষ্টতা দূর করেছে। এর সীমারেখা বর্ণনা করেছে এবং রূপরেখা তুলে ধরেছে। সুতরাং এই নীতিমালার মাধ্যমেই ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে উঠবে। একজন মুসলমানের কর্ম ও কর্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অনৈতিকতা ও খেয়ালীপনা থেকে মুক্ত হয়ে তার ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হবে অপূর্বতা। পুরুষত্ব ও পূর্ণতায় ফুটে উঠবে নিখুঁত সৌন্দর্য। ইসলাম নির্ধারিত সীমারেখার মাধ্যমে রবকে রাগান্বিতকারী নিষিদ্ধ কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া থেকে সাজসজ্জা গ্রহণকারী মুক্ত থাকবে। ভুল বোঝার কারণে আকৃতির বিকৃতি ঘটাবে না। সন্দেহ সংশয়ে পতিত হবে না।
শরিয়তের দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্যকারী সাজসজ্জায় সীমালঙ্ঘন করলে ধর্মীয় দায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। চারিত্রিক অবকাঠামো ধসে পড়ে। মান-সম্মানের ভিত নড়ে ওঠে। জাতির সম্মান ও সামাজিক শালীনতা দুর্বল হয়ে পড়ে। তথাপি এর আরও নানাবিধ ক্ষতিকারক ও ধ্বংসাত্মক পরিণতি রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যে নারী পুরুষের সাদৃশ্য রাখে এবং যে পুরুষ নারীর সাদৃশ্য রাখে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
ইসলাম মুসলমানের জন্য এমন ব্যক্তিত্ব গঠন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নিজস্ব বাহার ও জৌলুস। এছাড়া ইসলাম এর গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সীমানায় এমন সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছে, যা অনুসরণ করলে শরিয়তের বিরুদ্ধাচারণ হয় না অথবা অনুকরণ করলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব লঙ্ঘিত হয় না। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যে যে জাতির অনুসরণ করবে, সে সে জাতির অন্তর্ভুক্ত।
অনুরূপভাবে ইসলাম সৌন্দর্য ও পরিপাটির ক্ষেত্রে এমন অতিরঞ্জন বারণ করেছে, যার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির স্থায়ী বিকৃতি সাধন হয়। আল্লাহ তায়ালা ইবলিশের ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেন, তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে আশ্বাস দেব; তাদেরকে পশুদের কর্ণ ছেদন করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়। (সুরা নিসা : ১১৯)।
নারীদের রূপচর্চা ও সাজসজ্জার সাধারণ পরিধি হচ্ছে সৌন্দর্যকে বেগানা লোক থেকে লুকিয়ে রাখবে। এমন লাজুকতা ও শালীনতার সঙ্গে যা তাকে প্রাণবন্ত করবে এবং এমন সংযমের সঙ্গে যা তার ব্যক্তিত্বকে উন্নত করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তারা যেন তাদের গোপন সাজসজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মোমিনরা, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা নূর : ৩১)।
যখন আমরা সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার ব্যাপারে অধিক আলোচনা করব, তখন এমন একটি সৌন্দর্যের কথা স্মরণে রাখা শ্রেয়তর যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচ্ছন্ন রাখে এবং আত্মাকে পবিত্র করে। আর সেটি হচ্ছে ঈমানের মাধ্যমে অন্তরকে সুসজ্জিত করা। কেননা ঈমানের সঙ্গে সুশোভিত অন্তর প্রত্যেক সৌন্দর্য ও সুন্দরের উৎস। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন; কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই সৎপথ অবলম্বনকারী। এটা আল্লাহর কৃপা ও নেয়ামত, আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। (সুরা হুজুরাত : ৭-৮)।
হৃদয় যখন ঈমানের মাধ্যমে সুশোভিত হবে, তখন ঈমানদার ব্যক্তি সুন্দর মন, শ্রেষ্ঠ স্বভাব, উৎকৃষ্ট চালচলন ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠবে। এভাবে তার দ্বীন ও দুনিয়া সৌন্দর্যে ভরে যাবে। হৃদয় যখন ঈমানের মাধ্যমে সুসজ্জিত হবে, তখন অঙ্গপ্রত্যঙ্গও প্রতিটি ক্ষেত্রে সুসজ্জিত হবে। সুন্দর শব্দ ও উত্তম কথার মাধ্যমে জবানের সৌন্দর্য প্রকাশিত হবে। মুখ থেকে চিত্তাকর্ষক কথা নিঃসৃত হবে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি অন্যের মন জয় করবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই কতক কথাবার্তায় যাদু রয়েছে।
আমারা সাজসজ্জার ব্যাপারে সেসব নিয়ম অনুসরণ করব, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা ইসলামের পথে চলতে পারি, যেগুলো আমাদেরকে জান্নাতের নেয়ামত লাভের প্রেরণা জোগায়। যেখানে রয়েছে প্রত্যেক সৌন্দর্যের পূর্ণতা। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের যা কিছু দেওয়া হয়েছে, তা পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা বৈ নয়। আর আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম ও স্থায়ী। তোমরা কি বোঝ না?’ (সুরা কাসাস : ৬০)। আরও বলেছেন, তাদের আবরণ হবে চিকন সবুজ রেশম ও মোটা সবুজ রেশম এবং তাদের পরিধান করানো হবে রৌপ্য নির্মিত কংকর্ণ। (সুরা দাহর : ২১)।
দৈনিক গাইবান্ধা