মহিমাগঞ্জে একই ক্ষেতে এক মৌসুমেই দুইবার মিষ্টি আলুর চাষ
![মহিমাগঞ্জে একই ক্ষেতে এক মৌসুমেই দুইবার মিষ্টি আলুর চাষ মহিমাগঞ্জে একই ক্ষেতে এক মৌসুমেই দুইবার মিষ্টি আলুর চাষ](https://www.dainikgaibandha.com/media/imgAll/2024March/Screenshot_5-2403310524.jpg)
একই মৌসুমে, একই ক্ষেতে আর প্রায় একই খরচে দুইবার মিষ্টি আলু চাষ করে সাড়া ফেলেছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার একটি ছোট্ট চরের চাষিরা। কোন প্রকার সরকারি সহায়তা বা পরামর্শ ছাড়াই নিজেদের উদ্ভাবিত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে মিষ্টি আলু চাষে দ্বিগুণ লাভের স্বপ্ন দেখছেন তারা।
চলতি মৌসুমে নতুন এ পদ্ধতিতে ঝুঁকে পড়ছেন তারা। এর ফলে একদার অবহেলিত চরে এখন বছরে চারটি ফসল চাষ শুরু হয়েছে। কৃষি জমির বহুমুখী ব্যবহার করে উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া, বালুয়া তালপট্টি, বোচাদহ, রাখালবুরুজ ইউনিয়নের পারসোনাইডাঙা ও পাশর্^বর্তী সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের রামনগর ও কচুয়া গ্রামকেন্দ্রিক এই চরটিতে চলতি মৌসুমে নতুন এ পদ্ধতিতে মিষ্টি আলু চাষ হয়েছে ১৫০ বিঘারও বেশি জমিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জের দুই ইউনিয়ন আর পাশর্^বর্তী সাঘাটা উপজেলার একটি ইউনিয়নের ত্রিমোহনায় বাঙালী নদীর একটি চর। বালুয়া চর নামের ছোট্ট বাঙালী নদীর ছোট্ট এ চরে মাত্র পাঁচশ’ বিঘা জমি। একদা কাউন, যব বা সামান্য কিছু মিষ্টি আলুর বিচ্ছিন্ন জমির এ চর এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বদলে দিয়েছে এখানকার মানুষের ভাগ্য। চরের এ জমি যেন সোনা ফলানোর এক উর্বর ক্ষেত্র এখন। একদার নদী ভাঙ্গনের অভিশাপ এখন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে এখানে। বন্যা আর ভাঙ্গনে দুঃখের চর এখন সুখের চর হয়ে ধরা দিয়েছে এখানকার মানুষের কাছে। উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের চরবালুয়া কেন্দ্রিক এ চর এখন ‘সুখের চর’ হিসেবে পরিচিত। মূলতঃ মিষ্টি আলু চাষই বদলে দিয়েছে তাদের দিন। জাপানে রপ্তানীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির বাজার তৈরি হয়েছে এখানে উৎপাদিত মিষ্টি আলুর। চলতি মৌসুমে এ চরে প্রথম দফা উৎপাদিত আলু বিক্রি হয়েছে দু’ কোটি টাকারও বেশি।
জানা যায়, গত বছর এই এলাকায় আলেছ উদ্দিন নামের এক চাষীর উদ্যোগে জমি থেকে আলু তোলার সাথে সাথেই ফেলে দেয়া আলুর লতা রোপণ করে নতুন এ পদ্ধতির আলুর চাষ শুরু হয়। মাত্র এক বিঘা জমিতে এ পদ্ধতির চাষে তিনি দ্বিগুণ ফসল ঘরে তোলেন। তাঁর এ পদ্ধতি অনুসরণ করে এ মৌসুমে ওই চরে প্রায় দেড়শ’ বিঘা জমিতে দ্বিতীয়বার আলু রোপণ করেছেন চাষিরা। তাঁরা জানান, কার্তিক মাসের শুরুতেই মিষ্টি আলুর চারা রোপণ করে ৯০ দিন পর অর্থাৎ পৌষ-মাঘ মাসের মধ্যে আলু আহরণ ও বিক্রি করে ফেলেন। এরপর ওই জমিতে আলু সংগ্রহের সাথে সাথেই আলগা মাটি সমান করে ফেলে দেয়া আলুর লতা রোপণ করা হয়। কোন আয়াস ছাড়াই এই আলু বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সংগ্রহ করা হবে। এর ফলে প্রায় বিনা খরচে প্রথম দফার কাছাকাছি পরিমাণ বাড়তি আলু পাওয়ার আশা করছেন তারা।
দ্বিতীয় দফার এই আলু ঘরে তোলার পর ওই জমিতে তারা রোপণ করবেন ‘বর্ষালি’ নামের একটি হাইব্রিড জাতের ধান অথবা ভুট্টার। আশি^ন-কার্তিক মাসে এই ধান কাটার পর আবার চাষ করবেন আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রবিশস্যের। চলতি মৌসুমে এই চরে খায়রুল আলম রাজা, আলেছ উদ্দিন, হবিবর রহমান, মোনারুল ইসলাম, মজিবর রহমান, ফেরদৌস, আলম মিয়া ও ছাইদুর রহমানসহ প্রায় ৫০ জন চাষি একই জমিতে দ্বিতীয় দফায় মিষ্টি আলু চাষ করেছেন। বর্তমানে নতুন করে রোপণ করা মিষ্টি আলুর সবুজ পাতায় ঢেকে গেছে ওই চরের বিস্তীর্ণ এলাকা। আর সারা বছর ধরে কৃষিকাজ থাকায় কৃষি শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদার কারণে এখানকার শ্রমিকরাও পেয়েছেন সুখের নাগাল।
প্রথম দফায় ১৪ বিঘা আর দ্বিতীয় দফায় ১০ বিঘা জমিতে মিষ্টি আলুর চাষ করেছেন চর বালুয়া গ্রামের খায়রুল আলম রাজা। তিনি জনকণ্ঠকে জানালেন, কিছুটা আগাম চাষ করা জমিতে উৎপাদিত আলু তুলেই নতুন করে দ্বিতীয় দফায় আলু লাগাতে হয়। তাই আগামী বছর আমার অধিকাংশ জমিতেই আগাম আলুর চাষ করবো। এবার প্রথম দফায় প্রতি শতাংশ জমির উৎপাদিত মিষ্টি আলু বিক্রি হয়েছে গড়ে দুই হাজার টাকা। দ্বিতীয় দফায় গড়ে দেড় হাজার টাকার আলু বিক্রি হলেও তা দাঁড়াবে সাড়ে তিন হাজার বা তারও বেশি। এতে বিঘা প্রতি মিষ্টি আলু বিক্রি দাঁড়াচ্ছে কমপক্ষে সোয়া লক্ষ টাকা।
ওই চরের বাসিন্দা রাখালবুরুজ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও আলুচাষি আলেছ উদ্দিন বলেন, এক সময়ের দুঃখের চর এখন সুখের চরে রূপ নিয়েছে। এখানে কোনপ্রকার সরকারি বা কৃষি বিভাগের সহায়তা ছাড়াই তিন থেকে চারটি ফসল ফলাচ্ছেন কৃষকরা।
বালুয়া গ্রামের মিষ্টি আলুর ব্যাপারি আলম মিয়া জানান, গত কয়েক বছর ধরে এই চরে উৎপাদিত মিষ্টি আলু চাষিদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছি। এতে আমার মতো আরও অনেকের নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
চরবালুয়া গ্রামের চাষি ফেরদৌস আলম বলেন, কৃষিবিদ্যায় অশিক্ষিত চাষিরাই তাদের নিজ অভিজ্ঞতা থেকে ফসলচক্রের সঠিক ব্যবহার করে এখানকার তথা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন।
ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, বাঙালী নদীর এই চরের চাষিরা কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। কখনই এখানকার জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে না। তাদের কৃষিবিষয়ক সার্বিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।