শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ || ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রকাশিত : ০৬:৪৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১৭:৪৩, ১২ নভেম্বর ২০২৩

ব্যর্থতা দিয়েই বিসিএসের যাত্রা শুরু হয়েছিল

ব্যর্থতা দিয়েই বিসিএসের যাত্রা শুরু হয়েছিল

তাজবীউল ইসলাম ইসকেম। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফরিদপুরের বিলমামুদপুর গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে। তারপর অংশ নিয়েছেন ৪০ ও ৪১তম বিসিএসে। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয়বারে ১৪৬তম মেধাক্রম নিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন তাজবীউল ইসলাম। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক। তাজবীউল ইসলাম : দারুণ একটি সময় পার করছি। স্বপ্নের দিনগুলো বাস্তবে পেয়ে কিছুটা হতবিহ্বল। যেই স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বিসিএসের পেছনে ছুটেছি তার প্রতিফলন কতটুকু করতে পারব সেটা নিয়েই মূলত কিছুটা সংশয়ে আছি। তাজবীউল ইসলাম : আমি যখন যে বিষয়টা নিয়ে এগোই, সেটা খুব গভীর থেকে অনুভব করে এগোই। এটা একইসঙ্গে আমার দুর্বলতা এবং আমার প্রচণ্ড শক্তির একটি জায়গা।

তাজবীউল ইসলাম : আমি গ্রামের মানুষ। আমার ছোটবেলা কেটেছে ফরিদপুর সদরের বিলমামুদপুর গ্রামে। শৈশব পুরোটাই কেটেছে গ্রামীণ আবহে। গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো, বর্ষায় নতুন পানিতে মাছ ধরা, শরতে পূজার মেলা থেকে লাটিম কিনে খেলা এবং রোজার শেষে চাঁদ রাতে ঈদের চাঁদ দেখা আর বাজি ফোটানোর মধ্যে এখনো খুঁজে পাই আমার কৈশোর, আমার ছোটবেলা।

তাজবীউল ইসলাম : আমার তখন স্নাতক শেষ হয়েছে মাত্র। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া স্যারের শেষ কর্মদিবসে দেখেছিলাম তার প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর অশ্রুসিক্ত বিদায়। তখন খবরের শিরোনাম হয়েছিল, ‘ফরিদপুরবাসীকে কাঁদিয়ে গেলেন ডিসি সালমা তানজিয়া।’ ব্যাপারটি মনে দাগ কেটেছিল খুব। সাধারণ মানুষের মন জয় করেছিলেন তিনি তার যোগ্যতা আর কর্মস্পৃহা দিয়ে। সেদিন থেকেই মূলত বিসিএস প্রশাসনের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিসিএস বলতে আমি বিশেষভাবে সব সময় প্রশাসন ক্যাডারকেই বুঝেছি। আমার শৈশব স্মৃতিতে দুঃখে ভরা মানুষের যে জীবন চিত্র ফুটে ওঠে, বিসিএস প্রশাসন থেকে সেই মানুষগুলোর খুব কাছাকাছি থেকে কাজ করার সুযোগ পাব। এ ব্যাপারটি আমাকে খুব বেশি টানে।

তাজবীউল ইসলাম : আসলে স্নাতক পাস করার পরপরই আমি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে জয়েন করি। কারণ, বিসিএসের এই অনিশ্চিত যাত্রায় প্ল্যান বি থাকাটা খুব জরুরি বলে মনে করি। আমার বিসিএসের শুরুটাই হয়েছিল ব্যর্থতা দিয়ে। আমি ৪০তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং প্রিলিতে অকৃতকার্য হই। ভার্সিটিতে আমরা যারা একসঙ্গে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তাদের প্রায় সবারই প্রিলি হয়। শুধু আমিই বাদ পড়ে যাই

তাজবীউল ইসলাম : চাকরির পাশাপাশি আমি সব সময়ই চেষ্টা করেছি বিসিএসের সঙ্গে মানসিকভাবে সংযুক্ত থাকার। প্রতিদিন সকালে অন্তত কিছু সময় পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করতাম। বই থেকে অধ্যায়ভিত্তিক ছবি তুলে পিডিএফ বানিয়ে সব সময় মোবাইলে রাখতাম। একটু অবসর পেলেই চেষ্টা করতাম দুই-এক পাতা পড়ার। এভাবে পড়াটা হয়ত খুব বেশি হতো না কিন্তু বিসিএসের সঙ্গে মেন্টালি কানেক্টেড থাকা সম্ভব হতো। যেটা দীর্ঘদিনের যাত্রায় ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তাজবীউল ইসলাম : আমাদের রেজাল্ট হয় ৩ আগস্ট সন্ধ্যায়। আমি কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি আশা করি না। সব কিছুই সৃষ্টিকর্তার ওপরে ছেড়ে দিই। তারপরও রেজাল্টের দিন সকাল থেকে কিছুটা উত্তেজনা তো ছিলই। সারা দিনের অপেক্ষার পর তখন বিকেল ৫টা। অফিসে আর থাকতে পারলাম না। গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড ধরে লেকের পাশ দিয়ে আনমনে হেঁটে আসছিলাম। বরাবরের মতোই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্যে মনকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করছিলাম সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে যখন রেজাল্টের আশা ছেড়ে দিয়েছি তখন আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড টেক্সট করে আমার রেজাল্টের ব্যাপারটা জানায়। কনফার্ম হতে রেজাল্টটা ডাউনলোড করে সরাসরি রোলটা লিখে সার্চ দিলাম পিডিএসে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে শুধু এক ঝলক দেখলাম বিসিএস প্রশাসনের ঘরে আমার রোলটা হাইলাইট হয়েছে। পরের সময়টা আসলে কোনো শব্দে বা বাক্যে প্রকাশ করা যায় না। এমন একটি সময় যা কখনোই আমার জীবনে আগে কখনো আসেনি।

তাজবীউল ইসলাম : স্বপ্ন দেখতে তো কোনো বাধা নেই। তবে বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে। ৪১তম বিসিএসে আবেদন পড়েছিল প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার। ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মাত্র ২৫২০ জন। সফলতার হার ১ শতাংশেরও কম। তাই আমি বলি, এটি একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। আমার যারা সহপাঠী ছিলেন তাদের বেশির ভাগই বিসিএস না দিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়েছে। তারা দেশের জন্য অনেক ভালো ভালো কাজ করছে। তাজবীউল ইসলাম : আমার বিসিএসের শুরুটাই হয়েছিল ব্যর্থতা দিয়ে। আমি ৪০তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং প্রিলিতে অকৃতকার্য হই। ভার্সিটিতে আমরা যারা একসঙ্গে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, তাদের প্রায় সবারই প্রিলি হয়। শুধু আমিই বাদ পড়ে যাই। তখন ভেবেছিলাম বিসিএস প্রশাসনের স্বপ্নটা হয়ত কোনোদিন আর ছুঁতে পারব না। পরে আগের ভুলগুলো শুধরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কৌশলগত পরিবর্তন এনে প্রস্তুতি নিতে থাকি।

তাজবীউল ইসলাম : তাদের বলব কৌশলী হতে। প্রিলিতে দরকার প্রচুর রিভিশন দেওয়া। একটা টপিক শেষ করে পরের টপিকে যাওয়ার আগেই একবার করে রিভিশন দিয়ে নেওয়া। বারবার পরীক্ষা দেওয়া। এতে নেগেটিভ মার্কিং কম হয় আর নিজের দুর্বলতাগুলো ঝালিয়ে নেওয়া যায়। এখন অ্যাপসভিত্তিক প্রস্তুতি নেওয়া যায়, যেটা আমার কাছে অনেক কার্যকরী মনে হয়। আর রিটেন তো যতটা পড়া তারচেয়ে বেশি কৌশল আর ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর জায়গা। ডাটা, ফ্লো চার্ট, কোটেশন আর দ্রুত সাবলীল হাতের লেখা দিয়ে সুন্দর উপস্থাপনা অবশ্যই যেকোনো পরীক্ষার্থীকে অনেক এগিয়ে রাখবে।

স্নাতক পাস করার পরপরই আমি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে জয়েন করি। কারণ, বিসিএসের এই অনিশ্চিত যাত্রায় প্ল্যান বি থাকাটা খুব জরুরি বলে মনে করি তাজবীউল ইসলাম : ভাইভাতে মূলত পরীক্ষার্থীর মেধা ছাড়াও তার বাচনভঙ্গি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধিসহ সফট স্কিলগুলো দেখা হয়। তাই এখানে একটা কথাই বলব, নিজের মতো করে অভিজ্ঞতার আলোকে চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে ব্যতিক্রমী উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের অনুপাত কীভাবে বাড়ানো যায়। আমি আমার ট্রেডিং কোম্পানির চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে ভ্যাট, এআইটি, কাস্টমস ডিউটি, ক্যাপিটাল মেশিনারি প্রভৃতি কী পয়েন্টের আলোকে উত্তর করেছিলাম। ফলে গাইডের গতানুগতিক উত্তর থেকে ভিন্ন হয়েছিল এবং তারা বুঝতে পেরেছিলেন এটি সম্পূর্ণ আমার অভিজ্ঞতা লব্ধ মতামত। যেটি তারা বেশ পছন্দ করেছিলেন। তাজবীউল ইসলাম : অবশ্যই প্ল্যান বি প্রস্তুত রাখা। পুরোপুরি বেকার না থেকে একটি চাকরিতে ঢুকে প্রস্তুতি নেওয়া। চাকরির অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে নানাভাবে অনেক কাজে আসে। সেই সঙ্গে কাজের মধ্যে থেকে আয় করতে থাকলে হতাশায় পড়তে হবে কম।

তাজবীউল ইসলাম : তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সেবা করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সামান্য অংশীদার হতে পারলেই আমার প্রশাসন ক্যাডারের একজন সদস্য হিসেবে আমার জীবন সার্থক হবে। আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে চেষ্টা করতে চাই। বাকি পদ-পদবি বরাবরের মতোই সৃষ্টিকর্তা এবং ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে চাই। যেখানে যখন যতদূর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হবে সেটিই দায়িত্বের সঙ্গে পালন করতে পারলে আমি সন্তুষ্ট থাকব।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ