বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

৭১`রে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ:বোনসহ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম

৭১`রে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ:বোনসহ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম

১৯৬৫ সাল ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরেই বাংলাদেশের বিড়ি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। ভারত থেকে বিড়ি পাতা আসা বন্ধ হয়ে যায়। আমার বাবার মতো যাদের অল্প পুঁজির বিড়ি ফ্যাক্টরি ছিল তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি অন্য ব্যবসার চেষ্টা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত চায়ের দোকান দিয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যান। শহরে লোক, অফিস আদালত চালু না থাকলে চায়ের দোকান চলে না। আর চায়ের দোকান নির্ভর একটা পরিবারের বেঁচে থাকার জানালাগুলো ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও আমরা শহরেই ছিলাম কিন্তু গ্রামের অনিশ্চিত জীবনে ঝাঁপ দিতেই হয়। সনাতন ধর্মের মানুষ শুধু নয় সবাই তখন পাকিস্তানী মিলিটারির আশংকায় আতঙ্কিত।

আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর শ্বশুর বাড়ি গাইবান্ধা হওয়ায় আলাদাভাবে আর্মির টার্গেট হতে পারে। তবে এটা তখন আর কারো অজানা নেই যে, ‘খান সেনারা’ যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই লুটপাট আর আগুন দিয়ে সব কিছু পুড়িয়ে দিচ্ছে। অতএব পালাও । প্রতিবেশী দাবুদারা ঠিক করেছেন ভারতে চলে যাবেন। কিন্তু মালামাল বিশেষ করে তাদের ভাইবোনদের বইপত্র নিয়ে পড়লেন ভয়ানক বিপদে। আর্মিরা যদি আগুন দেয় তাহলে সব পুড়ে যাবে, ফিরে এসে কিভাবে আবারও শুরু করবে জীবন? সকলেই বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানিদের এই আগ্রাসন টিকবে না, দেশ মুক্ত হবেই। শুধু কখন সেটাই কেউ জানে না। আমার মা সনাতন ধর্মের প্রতিবেশীদের সব বই-খাতার দায়িত্ব নিলেন। বাড়িতে বইয়ের পাহাড় জমা হলো।

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে লোকজন ব্যাপকহারে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাওয়া শুরু করে। শহরের উচ্চপদস্থ আমলারও সরে যেতে থাকেন। মহকুমা প্রশাসক কার্যালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তা আজিজুল হক লিখেছেন-‘রংপুর কালেক্টরেটের এক কর্মচারী ১৪ বা ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় এসডিও সাহেবের বাংলোতে বার্তা নিয়ে এলো। বার্তাটি হলো- ‘অফিসাররা যেন নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন এবং কর্তব্যের খাতিরে নিজেকে বিপন্ন না করে...।’ (আমার উপলব্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা)। বিপন্নতাবোধ তখন সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল- জুমারবাড়ির চেয়ারম্যানের সৌজন্যে সেকেন্ড অফিসার আজিজুল হক সাহেবের পরিবারের জন্য গরুর গাড়ি জুটলেও অন্যদের পায়ে হাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না। তবে পথের দু’পাশের মানুষ যে যেমনভাবে পেরেছেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আর আমার এক বোন পথ হারিয়ে ফেললেও গ্রামের মানুষরাই আমাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। খোঁজ খবর করেছিলেন আশে পাশে। বিশ্বাস করেছিলেন যারা খোঁজ দিতে পারবে বলে মনে হয়েছে তাদের। হাত বদল হলেও শেষ পর্যন্ত মা-বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমরা। আমরা যাচ্ছিলাম ব্রহ্মপুত্রের দিকে কামারজানির পথে; আজিজুল হক আর তার আমলা বন্ধুর লক্ষ্য ছিল বগুড়া জেলার জোড়গাছায়। দুটো পথ দু’দিকে। কিন্তু আর্মির কব্জা থেকে দূরে চলে যাওয়ার জন্য সব পথই তখন দুরস্ত; সব পথই ঠিক পথ। সবার চেষ্টা প্রায় ভুলে যাওয়া গ্রামের আত্মীয়দের আত্মীয়তার আশ্রয়ে নিরাপদ থাকা।

পাকিস্তানি আর্মি শহর দখলের পর শুরু হয় জবরদখল আর লুটপাট। প্রথমে সংখ্যালঘুদের আর সরাসরি আওয়ামী লীগ করতেন, এমন মানুষদের বাড়িঘর টার্গেট করা হলেও পরে অনুপস্থিত যেকোন পরিবারই লক্ষ্যে পরিণত হয়।

সর্বাত্মক নির্যাতনের পরও সব সনাতন ধর্মীরা কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেননি। গাইবান্ধা শহরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। অনেক বাড়িতেই খুব বয়োজেষ্ঠ্য একজন দুজন থেকে গিয়েছিলেন। হাঁটার ধকল সহ্য করতে না পারার ভয় অথবা ভিঠাটা পাহারা দিয়ে রাখা -যেটাই কারণ হোক শেষ পর্যন্ত তারা থেকে গিয়েছিলেন। আমার এক সহপাঠীর যাওয়া হয়নি। চমকে উঠা বিস্ময়ে আমি একদিন মসজিদে দেখি তাকে। সে নামাজ পড়ছে। সাহস হয় না তাকে জিজ্ঞেস করতে। দেশ শত্র“মুক্ত হওয়ার পরেও প্রশ্নটা আমার বুকের মধ্যেই থেকে গেছে। কোনদিন জানা হয়নি। ওদের পাউরুটি, বিস্কুটের বেকারি ছিল। চালু রাখতে হয়েছিল ব্যবসাটা। কিন্তু কোন দামে?

সুন্দরগঞ্জ থানার সাবরেজিষ্ট্রারও ছিলেন সনাতনধর্মী। কেউ ভয়ে চুপ থাকে কেউ জোরে গান গায়; সাব রেজিষ্ট্রার ছিলেন দ্বিতীয় দলের। বুকে পোষ্টকার্ড সাইজের পাকিস্তানি পতাকা লাগিয়ে মোটাসোটা দীর্ঘদেহী এই মানুষটা বেশ সপ্রতিভ আর নির্ভিকভাবে চলাফেরা করতেন। ‘হিন্দুর’ এই ডাট সহ্য হয়নি অনেকের। বিশেষ করে শান্তি কমিটির সদস্যদের। এসডিও অফিসের কাছেই ছিল তার বাসা। একদিন বিকেলেই শুনলাম তার বাড়িতে আর্মির একটা দল ঢুকেছে, তারা ডাব খেতে চেয়েছে। সাধ মিটিয়ে ডাব খেয়েছে- তার পর ফেরার সময় সাব রেজিষ্ট্রারসহ তার পরিবারের সব সদস্যকে গুলি করে মেরেছে।

ডাব আর মুরগি ধরা ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের অত্যাচারের আরেটকা রূপ। পাড়ায় গিয়ে কিশোর বালকদের ধরে বলত গাছে ওঠো; ডাব পাড়ো। ডাব গাছে ওঠা সহজ ছিল না। না পারলে চড় থাপ্পর বেতের বাড়ি। দৌড় দিয়ে ছাড়া মুরগি ধরার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হতো বালকদের। অসফল হলে গালি, মার ছিল অনিবার্য ‘পুরস্কার’। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এরকম ত্রাসের রাজত্ব কয়েমের পাশাপাশি বিশেষ দুই-একটা বাড়ির শিশুদের সামনে বসিয়ে নিয়ে কোনো এক ক্যাপ্টেন খোলা জীপে ঘুরে বেড়াত।

বন্যার আশঙ্কা এবং শহরের ঘরবাড়ি রক্ষা আর জীবিকার তাগিদে আমরা সপরিবার শহরে ফিরে আসতে বাধ্য হই। চায়ের দোকান আবার চালু করেন বাবা। বড় ভাই আসে না। বড় ভাই আসেনি কেন? সেকি তবে যুদ্ধে গেছে? ততদিনে বাড়ি বাড়ি খোঁজ শুরু হয়। কার ছেলে কোথায় আছে? বাড়ি বাড়ি ‘হঠাৎ সার্চ’ চালু হয়। আমরা বিপদে পড়ি পরিবার প্রতিবেশীদের বইগুলো নিয়ে। সব বইয়েই তো ‘হিন্দু’ ছেলে-মেয়ের নাম লেখা। সার্চে এসে এসব বই দেখলে ভাববে কি? সবাইকে ‘হিন্দু’ বলে ধরে নিয়ে যাবে অথবা বাড়িটাই পুড়িয়ে দেবে। ঘুম হয় না সে সব চিন্তায়। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয় বাড়ির পিছনের পুকুরে বস্তায় ভরে ডুবিয়ে রাখা হবে। কিন্তু বড় ভাইকে কোথায় পাবে? সে তো মামাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। শান্তি কমিটি আর তাদের টিকটিকিদের চাপে শেষ পর্যন্ত মা তার ভাইদের কাছে গোপনে চিঠি পাঠান বড় ভাইকে গাইবান্ধায় পাঠিয়ে দেয়ার জন্য, না হলে তাদের সমূহ বিপদ হতে পারে। দারিয়াপুর ব্রিজ উড়িয়ে গভীর রাতে বড় ভাই মার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ঠিক হয় উনি এখন থেকে শহরেই থাকবেন।

বাবা রোজ সকালে তার দোকানে পাকিস্তানের পতাকা টাঙ্গাতেন, খুলে পকেটে রাখতেন সন্ধ্যা বেলায়। আবার পরের দিন বাঁশে ঝুলিয়ে দোকান খুলতেন। একদিন দোকান বন্ধ করে পকেটে পতাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পাকিস্তানি আর্মিরা তার পকেট চেক করে পতাকা পায়। সেটা তার অপরাধ। কোনোমতে সে যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।

চাল ডালের দাম খুব একটা না বাড়লেও অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে; কোরোসিন, দেয়াশলাই অমূল্য দ্রব্যে পরিণত হয়। আমরা কোনোমতে সন্ধ্যা দিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তাম।

জোর করে স্কুলও চালু করে আর্মিরা। শহরে আছে কিন্তু স্কুলে যায় না এটা একটা অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে থাকে। পড়াশোনা হতো না তবুও স্কুলে যেতে হতো আমাদের। মেয়েদের স্কুল শেষ পর্যন্ত আর চালু হয়নি। কেউ সাহস করেনি মেয়েদের পাঠাতে।

১৯৭১ সালে ঈদ হয়েছিল ২১ নভেম্বর। আমাদের জীবনে এই প্রথম একটা ঈদ যেখানে কোনো আনন্দ ছিল না। নতুন জামা দূরে থাক কারো মুখে হাসি ছিল না সেদিন। এপ্রিল-মে মাসের আতঙ্ক যেন আবার ঘন্টা বাজাতে থাকে। ঈদের পর দু’সপ্তাহ কাটতে না কাটতে ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। আমরা দল বেঁধে ছুটে যাই পিটিআই স্কুলে মিলিটারিদের ব্যারাকে। সব সুনসান পড়ে আছে তাদের ব্যবহৃত মালামাল, টিনের খাবার। অন্ধকারে পালিয়েছে সবাই। তারপর ছুটতে থাকি স্টেডিয়ামের দিকে। ওটা ছিল আর্মির হেড কোয়ার্টার কাম বধ্যভুমি। আমাদের খুশির বাতাস মিশে যায় অত্যাচার আর হত্যার নানা নিদর্শন দেখে।

দেশ শত্র“মুক্ত হওয়ার পর আবার সবাই শহরে ফিরে আসতে শুরু করে। কে বেঁচে আছে? কে বেঁচে নেই? সে হিসাব চলে- পাড়ায়, পাড়ায়; স্কুলে, স্কুলে, রাস্তায়, বাজারে, দোকানে। সবাই ফেরে না। তারা আর ফিরবে না।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ