বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:৩২, ২৬ মার্চ ২০২০

সূরা আলে ইমরান: ১-১২ আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও অর্থ পর্ব-১

সূরা আলে ইমরান: ১-১২ আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও অর্থ পর্ব-১

সূরা আলে ইমরানের ফজিলত : নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম বলেন, কোরআন ও কোরআনের ধারক বাহকরা কিয়ামতের দিন এমনভাবে হাজির হবে যে, সূরা আল বাকারা ও আলে ইমরান তাদের আগে আগে থাকবে।

নাওয়াস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এ দু’টি সূরার আগমনের তিনটি উদাহরণ দিয়েছেন, আমি সেগুলো এখনও ভুলিনি। তিনি বলেন, (১) এ দু’টি সূরা ছায়ার -মতো আসবে, আর এতদুভয়ের মাঝে থাকবে আলো। (২) অথবা এ দু’টি কালো মেঘ খন্ডের ন্যায়। (৩) অথবা ডানা বিস্তারকারী পাখীর ন্যায় আসবে এবং তাদের সাথীর পক্ষ হয়ে বিতর্ক করবে (তিরমিযি-১১৬)। 

নিম্নে ধারাবাহিকভাবে সূরা আলে ইসরানের আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও অর্থ উল্লেখ করা হলো।

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
الم
আলিফ লাম মীম (আয়াত-১)।

اللهُ لا إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ
অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই, তিনি চিরঞ্জীব।(আয়াত-২)।

শানে নুযুল-১ : একবার নাজরানের খৃষ্টানের একদল রাসূলে করিম (সা.) এর দরবারে এসে মনগড়া কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। এক পর্যায়ে তারা বলতে লাগল, হে মুহাম্মদ! যদি ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর পুত্র না হয়ে থাকে তাহলে বলুন ঈসা (আ.) এর পিতা কে? হুজুর (সা.) বললেন, বেয়াকুফ! সন্তানকে পিতার অনুরুপ হতে হয়। অথচ ঈসা (আ.) পানাহার করে চলাফেরা করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এসব কিছু থেকে পবিত্র। তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের শুরু থেকে নিয়ে আশিরও উর্দ্ধে আয়াত নাজিল করেন।

শানে নুযুল-২ : আল্লামা বাগবী (র.) কালবী এবং রবি ইবনে আনাস (রা.) এর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, এই আয়াতসমূহ নাজরানের প্রতিনিধি দলের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। এই প্রতিনিধি দলের লোক সংখ্যা ছিল ষাট। তারা উষ্ট্রের ওপর আরোহন করে এসেছিল। ষাটজনের এই দলের মধ্যে চৌদ্দজন ছিল উপনেতা। আর তিনজন ছিল নেতা। আহকেবের নামক এক ব্যক্তি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব যার পরামর্শ ছাড়া দলের কোনো লোক কোনো কাজ করত না। আহকেবের আসল নাম ছিল আব্দুল মাসিহ। প্রিয় নবী (সা.) যখন আসর নামাজ পড়েছেন তখন তারা মসজিদে প্রবেশ করে। তারা অত্যন্ত মূল্যবান এবং সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত ছিল। তাদের নামাজের সময় হলে প্রিয়নবী (সা.) এর অনুমতি নিয়ে তারা পূর্ব দিকে মুখ করে নিজেদের নামাজ আদায় করে। প্রিয় নবী (সা.) তাদেরকে ইসলাম কবুল করার আহবান জানালেন। তারা বলল, আমরা তো আপনার পূর্বেই ইসলাম কবুল করেছি। প্রিয় নবী (সা.) বললেন, তোমরা অসত্য কথা বলছো, তোমাদেরকে যে বিষয়টি ইসলাম থেকে বিরত রাখছে তা হলো হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র দাবী করা। তোমরা ক্রসেডের পূজা কর এবং শুকরের গোশত খাওয়াকে হালাল বলে মনে কর। তখন তারা বলল, যদি আল্লাহপাক ঈসা (আ.) এর পিতা না হন তাহলে তার পিতা কে? প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করলেন, তোমরা কি জান না যে, আমাদের পালনকর্তা সব কিছুর নিয়ন্ত্রণকর্তা, সবার নেগাহবান এবং রিজিকদাতা। তারা বলল, হ্যাঁ একথাও সত্য। তখন প্রিয়নবী (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এই সব কাজের কোনোটি ঈসা (আ.) এর নিয়ন্ত্রনাধীন রয়েছে কি? খৃষ্টান প্রতিনিধিদল বলল, না। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করলেন, তোমরা কি জানো না যে, আল্লাহ পাকের নিকট আসমান জমিনের কোনো কিছুই গোপন নেই। তখন তারা বলল, জানবো না কেন। নবী (সা.) এরশাদ করলেন তাহলে তোমরা বলো ঈসা (আ.)-কে যে খাছ এলেম আল্লাহ পাক দান করেছেন তা ছাড়া এই সব বিষয়ে তিনি কিছু কি জানতেন? তারা বলল, না। 

প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করলেন, আমাদের প্রতিপালক তার ইচ্ছা মোতাবেক ঈসা (আ.) কে মাতৃগর্ভে আকৃতি দান করেছেন। আমাদের প্রতিপালক পানাহার করেন না। প্রতিনিধি দল বলল, জ্বী হ্যাঁ! প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করলেন, তোমরা একথা উপলব্দি কর না যে, ঈসা (আ.)-কে তার মা এভাবেই তিনি ভূমিষ্ট করেছেন যেভাবে সাধারণত ভূমিষ্ট হয়। ঈসা (আ.)-কে এভাবেই আহার প্রদান করা হয়েছে যেভাবে শিশুদেরকে প্রদান করা হয়। আর ঈসা (আ.) পানাহার করতেন। প্রশ্রাব পায়খানাও করতেন। প্রতিনিধি দল বলল, হ্যাঁ এসব কথা আমরা জানি। তখন তিনি এরশাদ করলেন, তাহলে তোমরাই বলো তোমাদের দাবী মোতাবেক ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র কিভাবে হতে পারে? এ কথার পর প্রতিনিধিদল নিরব হয়ে যায়। তখন আল্লাহ পাক সূরায়ে আলে ইমরানের প্রথম ৮০ টি আয়াত নাজিল করেন। (নুরুল কোরআন-১৫৬)।  

نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ
অর্থ: তিনি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছেন সত্যতার সঙ্গে; যা সত্যায়ন করে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের। (আয়াত-৩)। 

مِن قَبْلُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ الْفُرْقَانَ إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ بِآيَاتِ اللّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَاللّهُ عَزِيزٌ ذُو انتِقَامٍ
অর্থ: নাজিল করেছেন তাওরত ও ইঞ্জিল, এ কিতাবের পূর্বে, মানুষের হেদায়েতের জন্যে এবং অবতীর্ণ করেছেন মীমাংসা। নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন আজাব। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশীল, প্রতিশোধ গ্রহণকারী। (আয়াত-৪)।

إِنَّ اللّهَ لاَ يَخْفَىَ عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاء
অর্থ: আল্লাহর নিকট আসমান ও জমিনের কোনো বিষয়ই গোপন নেই। (আয়াত-৫)

هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاء لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
অর্থ: তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়। (আয়াত-৬)।

هُوَ الَّذِيَ أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ فَأَمَّا الَّذِينَ في قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ اللَّهُ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلاَّ أُوْلُواْ الألْبَابِ.
অর্থ : (হে রাসূল!) তিনি আলাহ, যিনি তোমাদের উপর কিতাব নাজিল করেছেন। যার কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট। সেগুললো কিতাবের বুনিয়াদী বিষয়। আর কিছু রয়েছে দ্যর্থবোধক অথবা রূপক। যে লোকদের অন্তরে কোনো মনিলতা রয়েছে তারা ওই দ্যর্থবোধক আয়াতের অনুসরণ করে, যাতে ফেতনা সৃষ্টি হয়। আর এসব আয়াতের ব্যাখ্যা খুঁজে। অথচ এ আয়াতগুলোর সঠিক অর্থ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ জানেন না। আর যারা জানে সুগভীর তারা বলে থাকেন, ‘আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি (আল্লাহ তায়ালা সবকিছু জানেন), সবকিছু আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আর উপদেশ সেই সব লোক অর্জন করে যারা বুদ্ধিমান।’ (আয়াত-৭)।

শানে নুযুল : বর্ণিত আছে যে, অত্র আয়াতটি নাজরানের খ্রিস্টানদের বাদানুবাদের সময় নাজিল হয়। তথা তারা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাঁত ভাঙ্গা যুক্তি প্রমাণে অক্ষম হয়ে বলল যে, আপনি কি হজরত ঈসা (আ.)-কে كلمة الله روحٌ منه স্বীকার করেন না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তখন তারা বলল, হজরত ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র হবার জন্য এটাই যথেষ্ট। তখন অত্র আয়াতটি নাজিল হয় অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যে এই কোরআন অবতীর্ণ করেন তার কিছু অংশ মুহকাম তথা সুস্পষ্ট আর কিছু অংশ মুতাশাবিহ (অস্পষ্ট)। আর كَلِمَةُ اللهِ وَرُوْحٌ مِنْهُ টি مُتَشَابِه এর অন্তর্ভুক্ত যার অর্থ তোমরা জান না এবং এর تاويل ও তোমরা বুঝ না। অনর্থক তা নিয়ে তর্ক কর। 

رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করো না এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা। (আয়াত-৮)।

رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لاَّ رَيْبَ فِيهِ إِنَّ اللّهَ لاَ يُخْلِفُ الْمِيعَادَ
অর্থ: হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি মানুষকে একদিন অবশ্যই একত্রিত করবেঃ এতে কোনোই সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদার অন্যথা করেন না। (আয়াত-৯)।

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلاَ أَوْلاَدُهُم مِّنَ اللّهِ شَيْئًا وَأُولَـئِكَ هُمْ وَقُودُ النَّارِ
অর্থ: যারা কুফুরী করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর সামনে কখনো কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোযখের ইন্ধন। (আয়াত-১০)।

كَدَأْبِ آلِ فِرْعَوْنَ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا فَأَخَذَهُمُ اللَّهُ بِذُنُوبِهِمْ وَاللهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
অর্থ : তাদের অবস্থা ফেরআউন এবং তাদের পূর্ববর্তী লোকদের অবস্থা যেমন ছিল তেমন। তারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে তাদের পাপের জন্য পাকড়াও করেছিলেন। আর আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠিন। (আয়াত-১১)।

শানে নুযুল : উল্লি খিত অংশটি একত্ববাদের অস্বীকারকারীদের ভয়-ভীতি প্রদর্শনের লক্ষ্যে নাজিল হয়েছে, তারা ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্যের কারণে খুব গর্ববোধ করত, ফলে আল্ল াহ তা’আলা এসব আয়াত অবতীর্ণ করে বলেন যে, তাদের এসব কিছু কিয়ামতের কঠিন শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারবে না, এগুলো তাদের কোনোরূপ উপকার করতে পারবে না; বরং তারা অগ্নিতেই নিক্ষিপ্ত হবে।

قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُواْ سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ
অর্থ : কাফেরদরকে বলে দিন, খুব শিগগীরই তোমরা পরাবভূত হয়ে দোযখের দিকে হাকিয়ে নীত হবে সেটা কতই না নিকৃষ্ট অবস্থান। (আয়াত-১২) 

শানে নুযুল : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) যখন বদরের যুদ্ধে মুশরিকদেরকে পরাভূত করে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন ইহুদি সম্প্রদায়কে বনু কাইনুকার বাজারে সমবেত করে ঘোষণা দিলেন, হে ইহুদি সম্প্রদায়! কুরাইশদের বিপর্যয় নিশ্চয়ই তোমরা প্রত্যক্ষ করেছো। আল্লাহ পাক কর্তৃক তোমাদের উপরও এমন বিপর্যয় আসার পূর্বেই তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে নাও। জবাবে তারা বলল, হে মুহাম্মাদ! কুরাইশ যাদের যুদ্ধ সম্পর্কে আদৌ ধারণা নেই এমন গুটি কিছু মানুষকে নিহত করে ধোঁকা খেয়ো না। আমাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে দেখ। তখন টের পাবে যে, আমরা ভিন্ন কিছু। জবাবে আল্লাহ পাক আলোচ্য আয়াত নাজিল করেন।

চলবে...

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ