শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ || ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধায় সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ কেন্দ্র

মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধায় সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ কেন্দ্র

একাত্তরের ১ মার্চ পূর্ব ঘোষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে পূর্ব বাংলায় গণবিস্ফোরণ ঘটে। অন্যান্য স্থানের মত গাইবান্ধাতেও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষিত সকল কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হতে থাকে।

৩ মার্চ গোটা গাইবান্ধায় পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। বিকেলে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নবনির্বাচিত এম.এন.এ লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে যৌথভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি পালন করতে থাকে।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশনা অনুসারে সদর উপজেলাসহ মহকুমার সর্বত্র সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। বন্ধ হয়ে যায় সকল প্রকার খাজনা-ট্রাক্স আদায়। প্রতিটি বাড়িতে উড়তে থাকে কালো পতাকা। প্রায় প্রতিদিন মহকুমা শহরে লাঠিসোটাসহ পতাকা হাতে মিছিল হতে থাকে। ১২ মার্চ গাইবান্ধা মিউনিসিপ্যালিটি পার্কে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এম.এন.এ লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় স্বাধিকার আদায়ের দৃঢ় শপথ গ্রহণ করা হয়। একই দিনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা গণেশ প্রসাদের সভাপতিত্বে একটি ছাত্রসভাও অনুষ্ঠিত হয়।

১৪/১৫ মার্চে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএনএ লুৎফর রহমানকে আহবায়ক এবং সদর উপজেলার এমপিএ ওয়ালিউর রহমান রেজা ও মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আতাউর রহমানকে যুগ্ম আহবায়ক করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। অন্য ১৪ জন সদস্য হলেন- নবনির্বাচিত দুই এমএনএ শাহ্্ আব্দুল হামিদ ও ডা. সালায়মান মন্ডল, ৫ এমপিএ ডা. মফিজার রহমান, আবু তালেব মিয়া, জামালুর রহমান প্রধান, আজিজার রহমান, শামসুল হোসেন সরকার, ভাষা সৈনিক মতিউর রহমান, হাসান ইমাম টুলু, গোলাম কিবরিয়া, রাজনীতিক নির্মলেন্দু বর্মন, হাফিজার রহমান, মোহাম্মদ খালেদ ও নূরুল আবছার তারা মিয়া। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা উদ্যোগী হয়ে এলাকাভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে থাকে। তৎকালীন অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক এস.এস.জি.এ রিজভী ও ব্যাংক কর্মকর্তা রেজা শাজাহান প্রশাসনিক কার্যক্রমে মহকুমা সংগ্রাম কমিটিকে সহযোগিতা করেন।

২৩ মার্চ রিপাবলিকান দিবস ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার সর্বত্র পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলা শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ ঐ দিন দেশব্যাপী ‘প্রতিরোধ দিবস’ আহবান করে। সেই কর্মসূচি সফল করতে ২৩ মার্চ গাইবান্ধা পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে (বর্তমান স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ চত্বর) ছাত্রলীগের মহকুমা সভাপতি এম.এন.নবী লালুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র জনতার সমাবেশে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা নির্মলেন্দু বর্মন, মোহাম্মদ খালেদ, ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল আরেফিন তারেক, সৈয়দ শামস্-উল আলম হীরু, সদরুল কবীর আঙ্গুর, আমিনুল ইসলাম ডিউক প্রমুখ।

সমাবেশ শেষে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। পরে গোটা শহরের সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হয়। গাইবান্ধা কলেজের অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরীকে আহবায়ক ও অধ্যাপক মাজহারউল মান্নানকে যুগ্ম আহবায়ক করে গঠিত শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ২৪ মার্চ গাইবান্ধা শহরে মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঐদিন বিকালে ভিএইড রোডস্থ বার্মা ব্যাংক ভবনে গাইবান্ধা শহরে অবস্থানকারী অবসরপ্রাপ্ত বা ছুটিতে আসা সেনা, নৌ, বিমান ও আনসারবাহিনীর সদস্যদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে উপস্থিত ছিলেন নৌবাহিনীর কাজিউল ইসলাম, আজাদ হোসেন, সেনাবাহিনীর মাহবুব আলী প্রধান, মকবুল হোসেন প্রধান, এনামুল ইসলাম টুকু, আবুল হোসেন, বিমানবাহিনীর আলতাফ হোসেন, আফতাব হোসেন, খন্দকার তোফাজ্জল হোসেন, আনসার বাহিনীর মমতাজুল ইসলাম, আজিমউদ্দিন প্রমুখ। ঐ সভায় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

২৬ মার্চ সকালে গাইবান্ধার ওয়্যারলেস কেন্দ্রের মাধ্যমে মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক লুৎফর রহমান এমএনএ ও যুগ্ম আহবায়ক ওয়ালিউর রহমান রেজা এমপিএ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পেয়ে যান। ঐদিন মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাসান ইমাম টুলুর নেতৃত্বে গাইবান্ধা ট্রেজারি থেকে দু’শ রাইফেল ও গোলাবারুদ এবং আনসার ক্যাম্পের অস্ত্রগুলো নিয়ে ছাত্র যুবকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ২৭ মার্চ থেকে গাইবান্ধা কলেজ এবং ইসলামিয়া হাইস্কুল মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। গাইবান্ধা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অহিদউদ্দিন আহমেদ রোভার স্কাউটের তিন’শ কাঠের রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণে সহায়তা করেন। দুই জায়গাতেই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতে থাকেন সেনা, নৌ, বিমান ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা।

এরই ধারাবাহিকতায় থানা সদরগুলোসহ বিভিন্ন এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হতে থাকে। বিভিন্ন থানা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেনঃ সুন্দরগঞ্জ-মোসলেম আলী,সাদুল্লাপুর-আবু তালেব মিয়া,পলাশবাড়ীতে-তোফাজ্জল হোসেন,গোবিন্দগঞ্জ-জামালুর রহমান প্রধান,সাঘাটা-আতাউর রহমান। এরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। মহকুমা শহরের বাইরে গোবিন্দগঞ্জ কলেজ মাঠ,পলাশবাড়ী এফইউ ক্লাব, বোনারপাড়া হাই স্কুল মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-তরুণদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

১৬ এপ্রিল পর্যন্ত গাইবান্ধা মহকুমা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত ছিল। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা সাদুল্লাপুর হয়ে গাইবান্ধা শহরে ঢুকে পড়ে এবং দুইদিনের মধ্যে গোটা মহকুমার নিয়ন্ত্রন নেয়। গাইবান্ধার হাজার হাজার মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ছাত্র যুবকরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। গাইবান্ধা সদর,সাঘাটা,ফুলছড়ি,সাদুল্লাপুর ও সুন্দরগঞ্জের একাংশের মুক্তিযোদ্ধারা ১১নং সেক্টরে, গাইবান্ধা সদর ও সুন্দরগঞ্জের কেউ কেউ ৬ নং সেক্টরে এবং পলাশাবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা ৭নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। গাইবান্ধার কোম্পানী কমান্ডাররা হলেন-আমিনুল ইসলাম সুজা, এমএন নবী লালু,খায়রুল আলম,মাহাবুব এলাহী রঞ্জু,রোস্তম আলী খন্দকার,মফিজুর রহমান খোকা ও শাহজাহান আলী টুকু। আরেকজন কোম্পানী কমান্ডার সাইফুল ইসলাম সাজা নান্দিনা যুদ্ধে নেতৃত্বদানে ব্যর্থতার জন্য দায়ী হন এবং যুদ্ধ থেকে সরে দাড়ান।

গাইবান্ধায় সংঘটিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো-সাঘাটা থানার ত্রিমোহনী ঘাটের যুদ্ধ,সিংড়া রেল ব্রিজ অপারেশন,ভরতখালী ট্রেন অ্যাম্বুস,সাঘাটা থানা রেইড,ফুলছড়ি থানার ফলছড়ি থানা রেইড, ৪ ডিসেম্বরের সম্মুখ যুদ্ধ,কালাসোনা চরের যুদ্ধ,তিস্তামুখ ঘাটে জাহাজ আক্রমণ,রসুলপুর স্লুইসগেট আক্রমণ,ভাঙ্গামোড় অ্যাম্বুশ,উড়িয়ার চর অভিযান,সদর থানার বাদিয়াখালী সড়ক সেতুর যুদ্ধ,দারিয়াপুর ব্রিজ অপারেশন,নান্দিনার যুদ্ধ।

গাইবান্ধার শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৮৬ জন। সাধারণ শহিদের ৪৬১ জনের নাম জানা গেলেও এ সংখ্যা অনেক বেশী বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশে বীরত্বপূর্ন অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রাপ্ত ছয় জন মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন-

০১. শহিদ আব্দুল লতিফ বীর উত্তম, চরের হাট, পবনাপুর, পলাশবাড়ী
০২. বদিউল আলম বীর উত্তম, রামপুরা, গোবিন্দগঞ্জ
০৩. শহিদ আফসার আলী বীর বিক্রম, জালাগাড়ি, মহদীপুর, পলাশবাড়ী
০৪. মাহাবুব এলাহী রঞ্জু বীর প্রতীক, মুন্সীপাড়া, গাইবান্ধা
০৫. এটিএম খালেদ দুলু বীর প্রতীক, মধ্যপাড়া, গাইবান্ধা
০৬. শেখ আব্দুল মান্নান বীর প্রতীক, দিঘুহাট, গোবিন্দগঞ্জ।

গাইবান্ধায় পাকিস্তানি হানাদাররা অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে বধ্যভূমি ও গণকবরে মাটিচাপা দেয়। এলাকার উল্লেখযোগ্য গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে- গাইবান্ধা শহরের হেলাল পার্ক এবং পার্ক সংলগ্ন শাহ কফিলউদ্দিনের গোডাউন, কামারজানি বধ্যভূমি, গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি ব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি, পাখেড়া গ্রামের গণকবর, পলাশবাড়ী সওজ ডাকবাংলোর বধ্যভূমি, রামচন্দ্রপুর বধ্যভূমি, মুংলিশপুর-জাফর গণকব, ফুলছড়ি বধ্যভূমি, সুন্দরগঞ্জ গোয়ালের ঘাট বধ্যভূমি।

একাত্তরের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। একাত্তরের শহিদদের স্মরণে গাইবান্ধায় স্মৃতিফলক, স্মারকচিহ্ন, স্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- গাইবান্ধা পৌরপার্কের স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ, স্বাধীনতা প্রাঙ্গন, পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে স্মৃতিস্তম্ভ, মুন্সীপাড়া শহিদ মিনার, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনের শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ, শহিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন সড়ক, পশ্চিমপাড়ার শহিদ আসাদুজ্জামান নবাব পত্রিকা ফলক, পুলিশ লাইনের পার্শ্ববর্তী মাতৃভান্ডারের দুই ভাইয়ের সমাধিস্তম্ভ, খালেদ দুলু বীর প্রতীক সড়ক, সাঘাটায় পাঁচ শহিদের কবর ও স্মৃতিফলক, বোনারপাড়া শহিদ নামফলক, ফুলছড়ির বধ্যভূমির শহিদ মিনার, গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি স্মৃতিস্তম্ভ, পাখেড়া গ্রামের গণকবরের শহিদ মিনার, পলাশবাড়ী বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভ, মংলিশপুর-জাফর স্মৃতিফলক, সুন্দরগঞ্জ গোয়ালের ঘাট বধ্যভূমির শহিদ মিনার। এছাড়াও শহীদ ফজলুল করিমের স্মৃতিতে ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়ন ও সাঘাটার পাঁচ শহিদ স্মরণে মুক্তিনগর ইউনিয়ন নামকরণ করা হয়।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ

শিরোনাম

ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপনদেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রীরঈদে বেড়েছে রেমিট্যান্স, ফের ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রিজার্ভ১৪ কিলোমিটার আলপনা বিশ্বরেকর্ডের আশায়তাপপ্রবাহ বাড়বে, পহেলা বৈশাখে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রিতেনেইমারের বাবার দেনা পরিশোধ করলেন আলভেজ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ কী? কীভাবে করবেন?বান্দরবানে পর্যটক ভ্রমণে দেয়া নির্দেশনা চারটি স্থগিতআয়ারল্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রীকে শেখ হাসিনার অভিনন্দনজুমার দিনে যেসব কাজ ভুলেও করতে নেইগোবিন্দগঞ্জে কাজী রাশিদা শিশু পার্কের উদ্বোধনইউরোপের চার দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু