শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ২৫ নভেম্বর ২০২০

বিষয় যখন ভাস্কর্য কিছু বলা অপরিহার্য

বিষয় যখন ভাস্কর্য কিছু বলা অপরিহার্য

সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে তা অপসারণের দাবি করেছে দুটি ইসলামিক দল। দলগুলোর একটির প্রধান বলেছেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের চক্রান্ত তৌহিদি জনতা রুখে দেবে। সরকার যদি ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন থেকে সরে না আসে, তাহলে তারা কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। অন্য একটি দলের প্রধান তাদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সুসন্তান হতে পারে না।

এদিকে, ভাস্কর্যের সমর্থকরা ওই ইসলামী দলের নেতাদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। প্রয়োজনে কঠোর আন্দোলনের কথাও বলেছেন। এটি নতুন কোন বিষয় নয়। ধর্মের অজুহাতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এ সমস্যা সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের প্রবর্তক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেন কোট-স্যুট পরে, দাড়ি কামিয়ে পশ্চিমাদের মতো চলতেন সেই কথা খুব একটা তোলেন না এদেশের নামধারী জিন্নাহ সমর্থিত কিছু নসিহতকারী। সহজ-সরল মানুষের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে তারা ধর্মের কিছু কিছু অংশ নিয়ে মাতামাতি করেন, পুরোটা নয়। আবার আমরা যারা মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী, নামাজ পড়ি, রোজা রাখি- তারাও তাদের দৃষ্টিতে, বয়ানে সাচ্চা মুসলমান নই! তাদের কেউ কেউ ছবি তোলাকে নাজায়েজ বলেন। কিন্তু নিজেদের সব প্রয়োজনে তারা ছবি ব্যবহার করেন। সন্তানদের তা ব্যবহারে উৎসাহিত করেন। পত্রিকায় নিজেদের ছবি ছাপা হলে তা নিয়ে আলোচনা করে গর্ববোধ করেন। দেশের সবাই কি ওই দলগুলোর ভক্ত? তা-ও নয়। তাহলে বলা যায়, যেহেতু বাংলাদেশের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর তারা নেতৃত্ব দেন না, তাই তারা আমাদের নেতাও নন। শুধু ধর্মের জুজু তুলে তারা সহজ-সরল মানুষগুলোর ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে এক ধরনের খেলায় মেতে ওঠেন। যাদের সঙ্গে সরকারকেও কুলিয়ে উঠতে অনেক সময় বেগ পেতে হয়। তাদের নিয়ে কথা বলাটাও অনেক সময় হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর।

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বাঙালীর সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন। বাংলার ঘরে ঘরে গেছেন। তাদের কথা শুনেছেন। তাই দেশ স্বাধীনের পর ধর্ম বিষয়ে কেউ যেন বাড়াবাড়ি করতে না পারে সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণ করা হয়। সেই সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাষণে ব্যাখ্যা দেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।

‘আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, পবিত্র ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে কি জুয়োচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার- এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’

আগের কথাতেই ফিরতে হয়, ৭২ বছর আগে জিন্নাহ সাহেব ধর্মকে বর্ম বানিয়ে যে পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন, সেই ধারাতেই যেন কখনও কখনও বাংলাদেশকে আবার নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেটি কখনও সম্ভব নয়। কারণ, বাঙালী জাতি আমরা ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নই। ধর্মান্ধ হলে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হতো না। বাঙালী রক্ত দিত না। ধর্মের অপব্যবহার বাঙালী বহুকাল ধরে দেখে আসছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও দেখেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। এ কাজটির মাধ্যমে ফুটে ওঠে নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার। খোদ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, ইরান, ইরাকসহ অনেক মুসলমান অধ্যুষিত দেশে ভাস্কর্য রয়েছে। এ উপমহাদেশের অধিকাংশ খ্যাতনামা স্থাপত্যই মুসলমান শাসকদের অনন্য সৃষ্টি। আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গীরা যখন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করছিল, তখন ইরানের পার্লামেন্ট তার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল। ইরান, মিসর, মরক্কো, ইরাকের জাদুঘরে এবং উন্মুক্ত স্থানে অনেক দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য রয়েছে। কবি ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহ্র মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে ইরানে। ইরানের রাজধানী তেহরানে দু’বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয় সমকালীন ভাস্কর্য প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা। মুসলিম দেশ মিসরের কায়রো বিশ^বিদ্যালয়ে আছে মাহমুদ মোখতারের বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘মিসরের রেনেসাঁ’। বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার্থে মিসর গিয়ে থাকেন। ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ডানার ভাস্কর্যটি সবার নজর কাড়ে। দেশটির আল-মনসুর শহরে আছে মনসুরের একটি বিশাল ভাস্কর্য। অনেক সাধারণ সৈনিকের ভাস্কর্যও আছে। সৌদি আরবে উট, ঘোড়া বা গাংচিলের ভাস্কর্য দেখা যায়। রাজধানী জেদ্দার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাঙরি হর্স, মানব চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য অন্যতম।

সবচেয়ে বেশি মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ায় প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। এর মধ্যে বালিতে ভাস্কর্যের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা মালয়েশিয়াকে তাদের সেকেন্ড হোম মনে করেন। বিদেশে বসে যারা বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতিকে উস্কে দেন তারাও এই মুসলিম দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য ন্যাশনাল মনুমেন্ট দেখে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া বীরদের স্মরণে ১৫ মিটারের এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার অন্য উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য হলো- বাতু কেভসের বিখ্যাত মুরুগান, কুচিং হলিডে ইন হোটেলের সামনে মার্জার মূর্তি এবং কনফুসিয়াসের মূর্তি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে নির্মিত ভাস্কর্যের মধ্যে বুর্জ আল খলিফার বিপরীতে সংস্থাপিত আরবীয় যুগলের মূর্তি, দুবাইয়ের ওয়াফি অঞ্চলের প্রবেশপথে পাহারাদারের প্রতিমূর্তি হিসেবে সংস্থাপিত কুকুরের মূর্তি, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত মূর্তি উল্লেখযোগ্য। তুরস্ক ও কাতারের বিভিন্ন স্থানে দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য রয়েছে।

ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে শিল্প, সংস্কৃতিতে পুরো মুসলিম বিশ্ব এক হতে পারে। অন্যান্য প্রতিযোগিতার মতো পুরো মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক ভাস্কর্য মেলা’র আয়োজনও হতে পারে। এতে বিশ্বের কাছে মুসলিমদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধুনিক কৃষ্টি-কালচার তুলে ধরার সুযোগ থাকবে।

যদিও বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের সামনে থেকে গ্রীক দেবির ভাস্কর্যকে সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি আমরা বিস্মৃত হইনি। তারপরও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত ভাস্কর্য বাংলাদেশের সংস্কৃতিরই অংশ। কারও বিরোধিতায় কোথাও ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ হবে না কখনোই।

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ