শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ২২ মার্চ ২০২১

তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির সঞ্চিত অর্থে স্ব-সম্প্রদায়ের জন্য মাদরাসা

তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির সঞ্চিত অর্থে স্ব-সম্প্রদায়ের জন্য মাদরাসা

পাকিস্তানের একটি মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। সেখানে অনেকেই এখন ধর্মীয় শিক্ষা নিচ্ছেন। তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই এটাকে তাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন।

তৃতীয় লিঙ্গের একজন রানি খান। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে তিনি প্রতিদিন মাদরাসায় আসেন। সেখানে অন্যদের কুরআন শেখান তিনি। নিজের জমানো অর্থ ব্যয় করে এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন রানি খান। দেশটিতে এমন একটিই মাদরাসা আছে যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন।

পাকিস্তানের মতো একটি দেশে এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির কাছে এই মাদরাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অনেকটা একঘরে করে রাখা হয়। যদিও মাদরাসা অথবা মসজিদে নামাজ আদায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব মানুষের ওপর কোনো বিধি-নিষেধ নেই তবুও তারা প্রায় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

রানি খান (৩৪) বলেন, বেশিরভাগ পরিবারেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মেনে নেয়া হয় না। নিজেদের বাড়ি-ঘরেও জায়গা হয় না এসব মানুষের। ফলে এই অসহায় মানুষগুলো নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। তিনি বলেন, এক সময় আমি নিজেও তাদের মতোই ছিলাম।

কান্নাজড়িত কন্ঠে রানি খান তার অতীত জীবনের কথা স্বরণ করেন। তিনি জানান, মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাকে তার বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল এবং তিনি ভিক্ষা করে জীবন ধারণে বাধ্য হন।

১৭ বছর বয়সে তিনি তৃতীয় লিঙ্গের একটি গ্রুপে যুক্ত হন। তাদের কাজ ছিল বিয়ে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান করা। কিন্তু ওই গ্রুপেরই অপর এক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য যিনি অনেক আগেই মারা গেছেন তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর এসব থেকে সরে আসেন রানি খান। মৃত ওই নারী রানি খানকে তার নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করার অনুরোধ জানান।

গত অক্টোবরে প্রথম দুই কক্ষ বিশিষ্ট এই মাদরাসা চালু হয়। তার আগ পর্যন্ত রানি খান বাড়িতে বসেই কুরআন পাঠ শুরু করেন এবং মাদরাসায় যাওয়া-আসা করে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন।

এই মাদরাসায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে লোকজনকে কুরআন শিক্ষা দিচ্ছি। ইহকাল এবং পরকালের জন্যই আমার এই কাজ।

তিনি জানিয়েছেন, তার এই মাদরাসা সরকারি অনুদান পাচ্ছে না। তবে এখানকার শিক্ষার্থীদের চাকরি খুঁজে পেতে সহায়তা করবেন বলে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

মাদরাসার জন্য নিজের সামান্য অনুদান সংগ্রহের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কাপড় সেলাই ও এমব্রয়ডারি শেখাচ্ছেন তিনি। যাতে করে এসব বিক্রি করে মাদরাসার জন্য তহবিল গঠন করা যায়।

২০১৮ সালে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা ভোট প্রদানের মতো মৌলিক অধিকার লাভ করে এবং সরকারি নথিতে লিঙ্গ নির্বাচনের সুযোগ পায়।

কিন্তু তারপরেও তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষ দেশটিতে প্রান্তিক গোষ্ঠী হিসেবে জীবন যাপন করছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদেরকে অধিকাংশ সময়ই ভিক্ষাবৃত্তি, নাচ ও বেশ্যাবৃত্তির মতো পেশাকে বেছে নিতে হচ্ছে।

ইসলামাবাদের ডেপুটি কমিশনার হামজা শাফকাত রয়টার্সকে বলেন, ‘এই মাদরাসা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভূক্ত করতে সহায়তা করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অন্যান্য শহরেও স্থাপন করা হলে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটবে।’

গত বছর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানে প্রথম মাদরাসা চালু করা হয়। এছাড়া পাকিস্তানের বন্দরনগরী করাচিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা এর আগে নিজেদের জন্য একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেছে।

২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পাকিস্তানে ১০ হাজার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছে। তবে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারকর্মীরা বলছেন, ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে বর্তমানে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যের সংখ্যা তিন লাখের বেশি।

তৃতীয় লিঙ্গের এই মাদরাসার শিক্ষার্থী সিমরান খান বলেন, ‘যখন কুরআন পড়ি তখন আমার মন প্রশান্তিতে ভরে যায়।’ তিনি বলেন, ‘জীবনভর অপমান আর গ্লানি সহ্য করার চেয়ে এভাবে জীবন-যাপন করা অনেক বেশি ভালো।’

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ