বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৮:৪৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

কভিড সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত রোডম্যাপ

কভিড সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত রোডম্যাপ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ‘সুসমন্বিত রোডম্যাপ’ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে জাতিসংঘকে কভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় ‘অনুঘটকের ভূমিকা’ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এ লক্ষ্যে ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন।

গতকাল ‘কভিড-১৯ এর সময়ে এবং পরবর্তীতে উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন’ শীর্ষক একটি উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে গতকাল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫তম অধিবেশনের সাইড লাইনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। খবর বাসস।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কভিড-১৯ সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের একটি সুসমন্বিত রোডম্যাপ দরকার। এ সংকট দূর করতে ২০৩০-এর এজেন্ডা, প্যারিস চুক্তি এবং আদ্দিস আবাবা অ্যাকশন এজেন্ডা আমাদের ব্লুপ্রিন্ট হতে পারে।’ তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী যে ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন সেগুলো হচ্ছে : প্রথমত, জি-৭, জি-২০, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সংস্থা (ওইসিডি)ভুক্ত দেশগুলো, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক (এমডিবিএস) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট (আইএফআইএস)গুলোর বার্ষিক প্রণোদনা, ছাড়ের অর্থ এবং ঋণ মওকুফের পদক্ষেপ বৃদ্ধি করা উচিত। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোকে অবশ্যই তাদের ৭ শতাংশ ওডিএ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আরও বেশি বেসরকারি অর্থ ও বিনিয়োগ সরিয়ে আনা প্রয়োজন। ডিজিটাল বিভাজন বন্ধ করার জন্য আমাদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে আরও কাজে লাগাতে হবে।

তৃতীয় প্রস্তাবনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, কভিড-পরবর্তী জব মার্কেটের জন্য অভিবাসী শ্রমিকদের সহায়তা করে রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্নমুখী প্রবণতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের নীতিগত পদক্ষেপের প্রয়োজন।

চতুর্থ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোকে অবশ্যই শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজারে প্রবেশ, প্রযুক্তি সমর্থন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরও প্রবেশযোগ্য অর্থায়নের বিষয়ে তাদের অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। পঞ্চম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমপক্ষে ২০৩০ সাল নাগাদ মহামারীজনিত কারণে কোনো সম্ভাব্য পিছলে পড়া রোধ করতে এলডিসি থেকে উত্তরণ লাভকারী দেশগুলোর জন্য নতুন আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সর্বশেষ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে অর্থায়নের জন্য আরও জোর প্রচেষ্টা করা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কভিড-১৯ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সমতুল্য ১৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। তিনি  বলেন, নিয়মিত সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচিগুলোর আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি এই মহামারী চলাকালীন কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ ৩ কোটিরও বেশি মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে সরকার। বক্তব্যের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ড্রু হলনেস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেসকে এই সভা আহ্বানের জন্য ধন্যবাদ জানান।

কৃষিজমিতে শিল্পকারখানা নয় : কৃষিজমি ও বসতবাড়ি ছাড়া কেবল শিল্প এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ তথ্য জানান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আপনারা ব্যবসা করতে চান বা শিল্প করতে চান, তাহলে শিল্প এলাকায় যান। বাড়ির পাশের ধানের জমি নষ্ট করে শিল্প স্থাপন করবেন কেন? আমরা উৎসাহ দেব, আপনারা শিল্প এলাকায় এসে শিল্পকারখানা স্থাপন করুন। সেখানে আপনারা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও পাবেন। গ্যাস, রাস্তা, ব্যাংক সব পাবেন।

প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য নির্দেশনা তুলে ধরে এম এ মান্নান বলেন, শুধু মেডিকেল বর্জ্যই নয়, সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জোরদারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাস, নৌ, বিমানসহ যে কোনো স্টেশনের বর্জ্য অপসারণ করতে হবে। এ কাজে যেসব সংস্থা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নদীর পাড় দখলমুক্ত করতে হবে। কচুরিপানামুক্ত করে ড্রেজিং করতে হবে।

চার প্রকল্পের অনুমোদন : একনেক সভায় ৭৯৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা খরচে চারটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার দেবে প্রায় ৬২৩ কোটি ৬৫ লাখ আর বিদেশি ঋণ ১৭২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। একনেক চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়। গণভবন থেকে সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ হাসিনা। গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে শেরেবাংলানগর এনইসি সম্মেলনকক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে প্রকল্পের সার্বিক বিষয় সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

মন্ত্রী জানান, অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে তিনটি নতুন ও একটি সংশোধিত। সংশোধিত প্রকল্পটি হলো নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রকল্প-১ (চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ ও সংযুক্ত নৌপথ খনন এবং টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ)’ প্রকল্প। ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে ব্যয় বেড়ে এখন প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এতে সময়ও বেড়েছে। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটির সময় দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ‘মৌজা ও প্লটভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৩৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘ভৈরব নদ পুনঃখনন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২৩৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। চলতি বছরের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ, চাটখিল, সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী উপজেলার জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে খাল পুনঃখনন’ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।

এ ছাড়া একনেকে অনুমোদিত চার প্রকল্পের মধ্যে দুটিতে বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় হিসেবে সাড়ে ৯ কোটি টাকা চাওয়া হলেও তা কমিয়ে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন উন্নয়ন ও মৌজা এবং প্লটভিত্তিক জাতীয় ডিজিটাল ভূমি জোনিং।

জানা গেছে, আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন উন্নয়ন ও নৌরুট সচল রাখতে চট্টগ্রাম-ঢাকা-আশুগঞ্জ নৌরুটে ৯০০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হবে। পাশাপাশি টার্মিনালসহ আনুষঙ্গিক উন্নয়ন করবে সরকার। ছয়টি স্থানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে ষাটনল, চরভৌরবী, চাঁদপুর, মেহেন্দীগঞ্জ, সন্দ্বীপ ও নলচিড়াকে নির্বাচন করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় চারটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে। পানগাঁও ও আশুগঞ্জ টার্মিনাল উন্নয়ন করা হবে। ভৈরব বাজার, আলু বাজার, হিজলা, হরিনা, মজু চৌধুরী, ইলিশা (ভোলা), ভেদুরিয়া, লাহারহাট, বদ্দারহাট, দৌলতখাঁ, চেয়ারম্যান ঘাট, সন্দ্বীপ, তজুমদ্দিন, মনপুরা ও তমুরদ্দিনে ১৫টি লঞ্চ ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ করা হবে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল এবং ভোলা জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। ৩০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ রুটে বরিশালসহ অন্য রুটের সংযোগ রয়েছে। এ রুটের সঙ্গে সংযুক্ত নারায়ণগঞ্জ ও বরিশাল যুক্ত হলে মোট নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৯০০ কিলোমিটার। দেশের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ-পানগাঁও হয়ে ঢাকা-আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌরুটের দৈর্ঘ্য ৯০০ কিলোমিটার। এর প্রায় ৮০ কিলোমিটার অংশ হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ