মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ || ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ১৩ এপ্রিল ২০২১

কঠোর বিধিনিষেধ শুরু কাল

কঠোর বিধিনিষেধ শুরু কাল

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাল (বুধবার) ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ১৩ দফা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই আট দিন গণপরিবহন-বাস, ট্রেন, লঞ্চ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ থাকবে। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে (কর্ম এলাকা) থাকতে হবে।

শপিংমল ও অন্যান্য দোকানপাটও বন্ধ থাকবে। তবে নির্দিষ্ট সময় খোলা থাকবে কাঁচাবাজার ও নিত্যপণ্যের দোকান। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে এই সময়ের মধ্যে শিল্পকারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। শ্রমিকদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিশ্রমিক পরিবহণ ও গণমাধ্যমসহ সব ধরনের জরুরি পরিষেবা চালু থাকবে।

করোনা মহামারি প্রতিরোধে উল্লিখিত বিষয়সহ ১৩ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করে সোমবার অফিস আদেশ জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

বিধিনিষেধগুলো হলো : ১. সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি অফিস ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এসব অফিসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে (কর্ম এলাকা) অবস্থান করবেন। তবে বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং তৎসংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এই নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে। ২. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে। ৩. সব ধরনের পরিবহণ (সড়ক, নৌ, রেল, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহণ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না।

৪. শিল্পকারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। তবে শ্রমিকদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। ৫. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন: কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহণ, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাকসেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এই নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।

৬. অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা, চিকিৎসাসেবা, মরদেহ দাফন বা সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা কার্ড দেখানো সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে। ৭. খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শুধু খাদ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা যাবে। শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে।

৮. কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ৯. বোরো ধান কাটার জরুরি প্রয়োজনে কৃষিশ্রমিক পরিবহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে। ১০. সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে।

১১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করবেন। ১২. স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জুমা ও তারাবির নামাজের জামাতের বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করবে এবং ১৩. এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রয়োজনে সম্পূরক নির্দেশনা জারি করতে পারবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধ চলাকালে পণ্যবাহী পরিবহণ যাতে কোনোভাবেই যাত্রীবাহী পরিবহণে রূপ না-নিতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চলমান কার্যক্রম নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনি সভায় যুক্ত হন।

তিনি বলেন, ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণায় লঞ্চ ও ফেরিঘাটে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এ ধরনের মনোভাব করোনা সংক্রমণকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এদিকে উল্লিখিত বিধিনিষেধ মানাতে প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিধিনিষেধ জারির পর গণমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিওবার্তায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের (সোমবার) দেওয়া বিধিনিষেধগুলো যাতে সবাই যথাযথভাবে পালন করে, সেজন্য মাঠ প্রশাসনকে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।’ একইসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী নির্দেশনাগুলো তুলে ধরেন ভিডিওবার্তায়।

আগামী ১৪-২১ এপ্রিল ‘লকডাউনের’ সময় শিল্পকারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা না-করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। তিনি বলেন, আমরা প্রত্যেকেই জানি, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শিল্প-কলকারখানা চালু রাখতে পারি। তবে শিল্প এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই শিল্পকারখানাগুলো খোলা রাখা হবে।

সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে ক্লিনিক ভবনে করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আজ যদি কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকরা সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে। এর ফলে করোনাভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মালিকরা নিজেদের যেমন রক্ষা করবেন, সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদেরও রক্ষার চেষ্টা করবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। যদি না-মানেন, তাহলে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

আমাদের শ্রম আইন অনুযায়ী শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। এই বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য ইতোমধ্যে সারা দেশের জন্য ২৩টি মনিটরিং টিম করা হয়েছে। যারা ২০২০ সালের মার্চ থেকে কাজ করছে। যখন দেশে মৃত্যুহার বেড়ে গেছে, তখন তাদের নতুন করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবার করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ছুটি’ ঘোষণা হলেও পরে তার মেয়াদ বাড়ে কয়েক দফা। ওই সময় দেশে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। সে সময় সব অফিস-আদালত, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছুটির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকার সেই পরিস্থিতি ‘লকডাউন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

কিন্তু তাতে নিুবিত্তের জীবন-জীবিকা আর দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা অস্তিত্ব সংকটে পড়লে বিভিন্ন মহলের দাবিতে সরকার ৩১ মে-র পর থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ শিথিল করতে থাকে। বছরের শেষে এসে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ছাড়া আর সব কড়াকড়িই উঠে যায়। ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার ভাবনা থেকে মাঝে পুরো দেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপের পরিকল্পনা হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি এলাকায় সেই ব্যবস্থা চালানোও হয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা এগোয়নি।

এদিকে চলতি বছরের শুরুতে দেশে সংক্রমণের হার অনেকটা কমে আসে। সারা দেশে শুরু হয় করোনাভাইরাসের গণটিকাদান। চলতি বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দেশে দৈনিক শনাক্তের হার নেমে এসেছিল তিন শতাংশেরও নিচে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষদিক থেকে আবার দ্রুতগতিতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

প্রতিদিন রোগী বাড়তে থাকায় হিমশিম খেতে হচ্ছে ঢাকার হাসপাতালগুলোকে। এমন পরিস্থিতিতে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য গণপরিবহণ চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সরকার। গত রোববার এই বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার দিন তা আরও দুদিন বাড়ানো হয়।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়