অনন্য এক বিশ্বকাপের পর্দা উঠছে আজ
মিডিয়া সেন্টারে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০ জন সাংবাদিকের মধ্যে একটা চকিত জরিপ চালিয়ে দেখলাম, তাঁদের কেউই এখনো আল বায়ত স্টেডিয়ামটা চোখে দেখেননি। দোহা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই স্টেডিয়ামেই আজ পর্দা উঠছে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের।
ওই ৩০ সাংবাদিকের সবাই কাতার-ইকুয়েডর উদ্বোধনী ম্যাচ কাভার করবেন। ম্যাচের আগের দিনও স্টেডিয়াম না দেখার কথাটা এমন ঘটা করে বলার কারণ তো আছেই। বিষয়টা ব্যতিক্রমী।
বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের আগের দিন ওই ম্যাচ ঘিরে সব কর্মকাণ্ড ওই স্টেডিয়ামে হওয়াটাই নিয়ম। দুই দলের অধিনায়ক-কোচের সংবাদ সম্মেলনও। অথচ এখানে কাতার আর ইকুয়েডর দলের সংবাদ সম্মেলন হলো দোহায় মূল মিডিয়া সেন্টারে। সাংবাদিকেরাও সব এখানেই। বিশ্বকাপজুড়েই এমন হবে বলে অনুমান করা যায়। কারণ, এই প্রথম কোনো বিশ্বকাপ বলতে গেলে একটা শহরেই হচ্ছে।
আক্ষরিকভাবে ধরলে কথাটায় একটু ভুল আছে। কাগজে-কলমে শহর একাধিক। আজকের উদ্বোধনী ম্যাচের স্টেডিয়ামটা যে শহরে, সেটির নামই যেমন আল খোর। কিন্তু দূরত্বই বলে দিচ্ছে, এটিকে আলাদা শহর না বলে দোহার শহরতলি বলা ভালো। বিশ্বকাপের আটটি স্টেডিয়ামই এমন নৈকট্যে দাঁড়িয়ে। দোহা থেকে ৩৫ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যেই সব। একটু স্বাধীনতা নিয়ে তাই বলে ফেলাই যায়, এই বিশ্বকাপ হচ্ছে আসলে একটি শহরেই। বিশ্বকাপে সম্ভবত এই প্রথম কেউ চাইলে এক দিনে একাধিক ম্যাচ দেখে ফেলতে পারেন। অনেকে হয়তো তা দেখবেনও।
এসব লিখতে কাতারে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে সামান্যতম আগ্রহ আছে, এমন সবারই তা অনেক আগেই জানা হয়ে গেছে। তারপরও জানা তথ্যটা দিয়েই লেখা শুরু করার কারণ, কাতার বিশ্বকাপের অনন্যতাটা আবারও মনে করিয়ে দেওয়া। অনন্য আরও অনেক বিচারেই। এই বিশ্বকাপ আয়োজন করতে কাতারের ব্যয় হয়েছে নাকি ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অঙ্কটার তাৎপর্য বুঝতে একটা তথ্যই যথেষ্ট। কোনো দিন বিশ্বকাপ না খেলেই আয়োজক হয়ে যাওয়ায় কাতারের পূর্বসূরি দক্ষিণ আফ্রিকার ২০১০ বিশ্বকাপ আয়োজনে খরচ হয়েছিল এর ৬০ ভাগেরও কম।
এই বিশ্বকাপের আয়োজক হতে কাতারের ব্যগ্রতার কারণ ছিল একটাই। বিশ্বমানচিত্রে নিজেদের আলাদাভাবে তুলে ধরা। বিতর্কও সঙ্গী সেই শুরু থেকেই। ফুটবল ঐতিহ্যবিহীন একটা দেশের বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে যাওয়ায় পেট্রোডলারের ঝনঝনানিরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা।
সেই ঝনঝন শব্দ অনেকভাবেই বেজেছে বলে যে অভিযোগ, তা অনেক পুরোনো। মরুর দাবদাহ থেকে বাঁচতে এই প্রথমবারের মতো শীতকালীন বিশ্বকাপ। এই প্রথমবারের মতো একবারও বিমানে না উঠে বিশ্বকাপ খেলা শেষ করে যাবে দলগুলো। বিশ্বকাপের আয়োজক শহরে নির্দিষ্ট একটা সময়ে শুধু দুই দেশের সমর্থকেরাই থাকেন। এখানে সব দেশের সমর্থকেরা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবেন। ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো কাতার বিশ্বকাপের মহিমা বোঝাতে গতকাল যা একাধিকবার মনে করিয়ে দিলেন।
প্রথম তো আরও অনেক কিছুই। এর আগে আর কবে বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিনও ফুটবলের বদলে অন্য বিষয় নিয়ে এত কথাবার্তা হয়েছে! কবে ফিফা সভাপতি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়ে রীতিমতো রণদুন্দুভি বাজাতে শুরু করেছেন!
বিশ্বকাপের আয়োজক হতে প্রচুর অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ তো কাতার বিশ্বকাপ পাওয়ার দিন থেকেই। এরপর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিতর্কের পর বিতর্ক। স্বাগতিক দল ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনতে প্রতিপক্ষ দলের আট খেলোয়াড়কে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে—এই অভিযোগই বা এর আগে কোন বিশ্বকাপে শোনা গেছে! কাল সংবাদ সম্মেলনে কাতারের স্প্যানিশ কোচ ফেলিক্স সানচেজকেও বিব্রতকর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো। ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেবেন, এটা তো জানাই ছিল। সঙ্গে আধুনিক সময়ের একটা বাস্তবতার কথাও মনে করিয়ে দিলেন সানচেজ, ‘ইন্টারনেট দারুণ জিনিস, তবে একই সঙ্গে খুব বিপজ্জনকও।’
কথাটা খুবই সত্যি। ইকুয়েডরের খেলোয়াড়দের ঘুষ দিয়ে উদ্বোধনী ম্যাচে কাতারের জয় নিশ্চিত করার খবরটির সূত্রপাত তো একটা টুইটই। হয়তো গুজবই। কিন্তু ওই টুইটের দাবি অনুযায়ী আজ সত্যি সত্যি যদি দ্বিতীয়ার্ধের এক গোলে কাতার জিতে যায়, তাহলে কী হবে, তা শুধু ভাবার চেষ্টা করছি। কাকতালীয় বলে কেউ কি তা মেনে নেবে?
এমনিতে আজকের ম্যাচে স্বাগতিকের চিরন্তন সুবিধা ছাড়া কাতারের জয়ের পক্ষে আর একটা কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে দুই দলের মধ্যে যদিও এমন আকাশ-পাতাল কোনো পার্থক্য নেই।
কাতারের র্যাঙ্কিং ৫০, ইকুয়েডরের ৪৪। তবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে উরুগুয়ের বিপক্ষে জয় আর ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সঙ্গে ড্র বুঝিয়ে দিচ্ছে, র্যাঙ্কিংয়ে ৬ পার্থক্যটা আসলে শুধুই সংখ্যা। যা মোটেই দুই দলের শক্তির ব্যবধানের প্রতিফলক নয়।
অনেক দিক থেকেই এই বিশ্বকাপ অনন্য বলছিলাম। সেই অনন্যতার আরেকটি উদাহরণ, বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিনও বিশ্বকাপের হাওয়া একদমই টের পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় লোকজন এই আয়োজনকে কীভাবে দেখছে, সারা বিশ্বকে বরণ করে নেওয়ার এই সুযোগ পেয়ে তারা কতটা উদ্বেলিত—এটা জানারও যেমন কোনো উপায় নেই। দোহায় আড়াই দিন কাটিয়ে দেওয়ার পরও কাতারি কারও সঙ্গে দেখা হলে তো!
দৈনিক গাইবান্ধা