বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৭:৩৭, ২১ মে ২০২২

যে ভালোবাসায় ঈমান বাড়ে (প্রথম পর্ব)

যে ভালোবাসায় ঈমান বাড়ে (প্রথম পর্ব)

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যেভাবে নবীগণের সর্দার, তেমনিভাবে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেও তিনি সকলের চেয়ে মহান। তিনি এমন এক উৎকৃষ্ট সমাজ রেখে গেছেন, যার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীরাও উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে। কারণ তিনি সমাজ বিনির্মাণ করেছেন ওহীর ভিত্তিতে, যে ওহী মানব সভ্যতার প্রকৃত উৎকর্ষ নিশ্চিত করে। আর তাই এই উম্মতের জন্য তাকে মনোনীত করা উম্মতের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ। তবে এই অনুগ্রহ থেকে তারাই মূলত উপকৃত হয়, যারা ঈমান আনে। তাই আয়াতে ব্যাপকভাবে উম্মতের বদলে শুধু মুমিনদের কথা বলা হয়েছে।

তিনি এসেছেন রহমত হয়ে

তিনি জগদ্বাসীর জন্য রহমত হয়ে এসেছেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, '(হে নবী!) আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি।' (সূরা আম্বিয়া (২১) : ১০৭)

ইমাম তাবারী রাহ. বলেছেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জগতের সকলের প্রতি আল্লাহ পাকের রহমত। মুমিন-কাফির নির্বিশেষে সকল মাখলুকই কিয়ামত পর্যন্ত এই মহান রহমতের মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকবে। মুমিনকে তো আল্লাহ তাআলা তার মাধ্যমে হিদায়াত দান করেছেন। তার উপর ঈমান আনা এবং তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে পয়গাম নিয়ে এসেছেন সে অনুযায়ী আমল করার কারণে তাকে জান্নাত দেবেন। আর এই উম্মতের অবিশ্বাসীকে তার কারণে পূর্ববর্তী উম্মতের অবিশ্বাসীর মতো নগদ শাস্তি দেবেন না। (তাফসীরে ত্ববারী ১৮/৫৫২)

মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, কাফেরদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জিহাদ করেছেন সেটাও ব্যাপকার্থে প্রকাশ্য রহমত ছিল। কেননা এর মাধ্যমে বড় রহমত, যা তিনি আল্লাহর তরফ থেকে নিয়ে এসেছিলেন তার হেফাজত হয়েছিল। তাছাড়া এর ফলে এমন অনেকের ঈমানের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি খুলে গিয়েছিল, যে ব্যাপারে তারা স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বয়ে বেড়াচ্ছিল। (দ্র. তাফসীরে উসমানী)

উম্মতের প্রতি নবীজীর দরদ

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দয়া-মমতার সাগর। উম্মতের প্রতি ছিল তার গভীর মায়া, সীমাহীন মমতা এবং তাদের কল্যাণ সাধনে ছিলেন সদা ব্যাকুল, ব্যতিব্যস্ত। তাদেরকে তিনি নিঃস্বার্থ ভালোবাসতেন। তিনি তাদের থেকে না এর কোনো প্রতিদান চাইতেন, আর না কৃতজ্ঞতা কামনা করতেন। চাইতেন শুধু তাদের নাজাত ও সফলতা। চাইতেন যেন উম্মত হেদায়েতের পথ হারিয়ে না ফেলে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আযাব তাদেরকে আক্রান্ত না করে।

হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা.) বলেছেন, 'অর্থাৎ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করলেন, যাতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কথা উল্লেখ আছে : (তরজমা) “হে আমার রব! এসব প্রতীমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত হবে।” (আর সেই আয়াতও পড়লেন যেখানে আছে) (তরজমা) “(এবং ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন,) যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতও পরিপূর্ণ।' অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!!’ তখন আল্লাহ তাআলা বললেন, হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর সে কেন কাঁদে? যদিও তোমার রবই ভালো জানেন। অতপর জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবীজীর কাছে এসে তা জিজ্ঞাসা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব খুলে বললেন। যদিও আল্লাহ তাআলা সব জানেন। অতপর আল্লাহ তাআলা বললেন, হে জিবরাঈল! মুহাম্মাদকে গিয়ে বলো, আমি অচিরেই তোমার উম্মতের ব্যাপারে তোমাকে সন্তুষ্ট করব, ব্যথিত করব না।' (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০২)

আরেক হাদীছে উদাহরণ টেনে নবীজী উম্মতের প্রতি তার দরদকে এভাবে বুঝিয়েছেন, 'অর্থাৎ, আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত সে ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত, যে আগুন জ্বালালো, ফলে ফড়িংদল পতঙ্গরাজি তাতে পড়তে লাগল। আর সে ব্যক্তি তাদের তা থেকে তাড়াতে লাগল। অনুরূপ আমিও আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমর ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ।' (সহীহ মুসলিম: ২২৮৫)

উম্মতের হেদায়েত লাভে তার দরদ ও আত্মত্যাগের মাত্রা বুঝবার জন্য কুরআন কারীমের এই একটি আয়াতই যথেষ্ট। অর্থাৎ, মনে হয় যেন আপনি ওদের পিছনে পরিতাপ করতে করতে স্বীয় প্রাণ নাশ করে ফেলবেন, যদি ওরা এই বাণীর প্রতি ঈমান না আনে। (সূরা কাহ্ফ: ৬)

এমনকি অকৃতজ্ঞ উম্মতের ধৃষ্টতার সামনেও তার দয়ার বাঁধ ছিল অটল। তায়েফবাসীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাওহীদের বাণী, হেদায়েতের পয়গাম। তাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন মুক্তির পথ। কিন্তু তাদের অজ্ঞতা তাদের উপর চেপে বসল। চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে তারা নবীজীর উপর চড়াও হল। পাথরের আঘাতে তাকে জর্জরিত করল। আঘাতে আঘাতে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলল। কেঁপে উঠল আল্লাহর আরশ। পাঠালেন জিবরীল আমীনকে।

জিবরীল বললেন, 'আপনার কওম আপনার উদ্দেশে যা বলেছে এবং আপনার সাথে যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা দেখেছেন। আপনার আদেশ পালনে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাকে পাঠিয়েছেন। তখন পাহাড়ের ফিরিশতা আমাকে সম্বোধন করে সালাম দিল এবং বলল, আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতা। হে মুহাম্মাদ! আপনার কওমের বক্তব্য আল্লাহ শুনেছেন। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার আদেশ পালন করতে। আপনি আমাকে কী আদেশ করবেন করুন। আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে আমি দুই পাহাড়ের মাঝে এদেরকে পিষে ফেলব।'

কিন্তু দয়ার সাগর নবীজী জবাব দিলেন, '(আমি এটা চাই না;) বরং আমি আশা রাখি, আল্লাহ তাআলা এদের বংশধরদের মাঝে এমন মানুষ বের করবেন, যারা এক আল্লাহ্র ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে শরীক করবে না।' (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৯৫; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৩১)

একান্ত জাগতিক বিষয়েও উম্মতের বিপদাপদে নবীজী ছিলেন নিঃস্বার্থ সহযোগিতার আধার। সাহাবী হজরত আবূ হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'অর্থাৎ, দুনিয়া ও আখেরাতে আমি প্রত্যেক মুমিনেরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতর। ইচ্ছা হলে তোমরা এ আয়াতটি তিলাওয়াত কর- 'মুমিনদের পক্ষে নবী তাদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ।' 

তাই সম্পদ রেখে কোনো মুমিন মারা গেলে আত্মীয়-স্বজন তার ওয়ারিস হবে। আর যদি সে ঋণ কিংবা অসহায় পরিজন রেখে যায়, তবে তারা যেন আমার নিকট আসে। আমিই তাদের অভিভাবক।' (সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৮১)

দেখুন, স্বার্থহীনতার কেমন আদর্শ ছিলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একদিকে অসহায় উম্মতের অভিভাবক তিনি। কিন্তু অপরদিকে তাদের বিত্ত বৈভবের দাবিদার নন। আর তাই তো অন্যত্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'অর্থাৎ, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য।' (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ৮০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৪৩১)

বরং তিনি জন্মদাতা পিতার চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ?

ইহলোক পাড়ি দিয়ে আখিরাতের কঠিন মুহূর্তেও এ উম্মতের মুক্তির সুপারিশ করবেন তিনি। এই প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'অর্থাৎ, প্রত্যেক নবীকে এমন একটি বিশেষ দুআর অধিকার দেয়া হয়েছে, যা কবুল করা হবে। তারা (দুনিয়াতে) সে দুআ করেছেন এবং তা কবুলও করা হয়েছে। আর আমি আমার দুআ কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের উদ্দেশ্যে মূলতবী রেখেছি।' (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৯)

ইমাম নববী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, 'অর্থাৎ, এই হাদীসে উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ মায়া-মমতা ও দরদের কথা এবং তাদের কল্যাণসাধনে তার প্রচেষ্টার কথা ফুটে উঠেছে। তাইতো তিনি এই উম্মতের জন্য তার বিশেষ দুআ তাদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য তুলে রেখেছেন।'

উম্মতের প্রতি নবীজী কী পরিমাণ দয়ার্দ্র ও অনুগ্রহশীল ছিলেন, এখানে তার কিঞ্চিতই বিবৃত হল। আল্লাহ তাআলা এককথায় বড় সুন্দরভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, '(হে মানুষ!) তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যেকোন কষ্ট তার জন্য অতি পীড়াদায়ক। সে সতত তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, পরম দয়ালু।' (সূরা তাওবা (৯) : ১২৮)

তো যেই নবী উম্মতের জন্য এতটা মহানুভব ছিলেন; সেই নবীর প্রতি উম্মতের আচরণ কেমন হওয়া চাই?

চলবে......

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ