শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১২ জুলাই ২০২১

ত্যাগের পরীক্ষায় জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.)

ত্যাগের পরীক্ষায় জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.)

আমাদের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছেন। তিনি সব পরীক্ষায় যথার্থভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এসব পরীক্ষা সমূহ ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। এক. বাবেল জীবনের পরীক্ষা সমূহ এবং দুই. কেন‘আন জীবনের পরীক্ষা সমূহ। 

৪র্থ পরীক্ষা: খাৎনা করণ : ইব্রাহিম (আ.) এর প্রতি আদেশ হল খাৎনা করার জন্য। এ সময় তার বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছর। হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেরী না করে নিজেই নিজের খাৎনার কাজ সম্পন্ন করলেন। বিনা দ্বিধায় এই কঠিন ও বেদনাদায়ক কাজ সম্পন্ন করার মধ্যে আল্লাহর হুকুম দ্রুত পালন করার ও এ ব্যাপারে তার কঠোর নিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া যায়। 

খাৎনার এই প্রথা ইব্রাহিম (আ.) এর অনুসারী সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আজও চালু আছে। মূলত খাৎনার মধ্যে যে অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীগণ তা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন। এর ফলে খাৎনাকারীগণ অসংখ্য অজানা রোগ-ব্যাধি হতে মুক্ত রয়েছেন এবং সুস্থ জীবন লাভে ধন্য হয়েছেন। এটি মুসলিম এবং অমুসলিমের মধ্যে একটি স্থায়ী পার্থক্যও বটে। 

৫ম পরীক্ষা: পুত্র কোরবানি : একমাত্র শিশু পুত্র ও তার মাকে মক্কায় রেখে এলেও ইব্রাহিম (আ.) মাঝে-মধ্যে সেখানে যেতেন ও দেখা-শুনা করতেন। এভাবে ইসমাঈল ১৩/১৪ বছর বয়সে উপনীত হলেন এবং পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার উপযুক্ত হলেন। বলা চলে যে, ইসমাঈল যখন বৃদ্ধ পিতার সহযোগী হতে চলেছেন এবং পিতৃহৃদয় পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন, ঠিক সেই সময় আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) এর মহববতের কোরবানি কামনা করলেন।

বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র নয়নের পুত্তলী ইসমাঈলের মহববত ইব্রাহিম (আ.) কে কাবু করে ফেলল কি-না, আল্লাহ যেন সেটাই যাচাই করতে চাইলেন। ইতিপূর্বে অগ্নিপরীক্ষা দেবার সময় ইব্রাহিম (আ.) এর কোনো পিছুটান ছিল না। কিন্তু এবার রয়েছে প্রচন্ড রক্তের টান।

দ্বিতীয়তঃ অগ্নি পরীক্ষায় বাদশাহ তাকে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এবারের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় ও স্বহস্তে সম্পন্ন করতে হবে। তাই এ পরীক্ষাটি ছিল পূর্বের কঠিন অগ্নি পরীক্ষার চেয়ে নিঃসন্দেহে কঠিনতর। সুরা ছাফফাত ১০২ আয়াত হ’তে ১০৯ আয়াত পর্যন্ত এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনাটি নিম্নরূপ: ‘যখন (ইসমাঈল) পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হ’ল, তখন ইব্রাহিম (আ.) তাকে বললেন, হে আমার বেটা! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। এখন বল তোমার অভিমত কি? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’ (সুরা ছাফফাত ৩৭/১০২) ।

ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কা থেকে বের করে ৮ কি: মি: দক্ষিণ-পূর্বে মিনা প্রান্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে বর্তমানে যে তিন স্থানে হাজীগণ শয়তানকে পাথর মেরে থাকেন, ঐ তিন স্থানে ইবলীস তিনবার ইব্রাহিম (আ.) কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। আর তিনবারই ইব্রাহিম (আ.) শয়তানের প্রতি ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন।

সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য এবং শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ বিষয়টিকে হজ অনুষ্ঠানের ওয়াজিবাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানেই অনতিদূরে পূর্ব দিকে ‘মসজিদে খায়েফ’ অবস্থিত।

অতঃপর পিতা-পুত্র আল্লাহ নির্দেশিত কোরবানগাহ ‘মিনায়’ উপস্থিত হলেন। সেখানে পৌঁছে পিতা পুত্রকে তার স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলেন এবং পুত্রের অভিমত চাইলেন। পুত্র তার অভিমত ব্যক্ত করার সময় বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’। ইনশাআল্লাহ না বললে হয়ত তিনি ধৈর্য ধারণের তাওফীক পেতেন না।

এরপর তিনি নিজেকে ‘ছবরকারী’ না বলে ‘ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ বলেছেন এবং এর মাধ্যমে নিজের পিতা সহ পূর্বেকার বড় বড় আত্মোৎসর্গকারীদের মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিজেকে অহমিকা মুক্ত করেছেন। যদিও তার ন্যায় তরুণের এরূপ স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গের ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছিল বলে জানা যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর (পিতা-পুত্র) উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শায়িত করল’। ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহিম’! ‘তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলগণের প্রতিদান দিয়ে থাকি’। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। ‘আর আমরা তার পরিবর্তে একটি মহান যবহ প্রদান করলাম’ ‘এবং আমরা এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’। ‘ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক’ (সুরা ছাফফাত ৩৭/১০৩-১০৯) 

বর্তমানে উক্ত মিনা প্রান্তরেই হাজীগণ কোরবানি করে থাকেন এবং বিশ্ব মুসলিম ঐ সুন্নাত অনুসরণে ১০ই যুলহিজ্জাহ বিশ্বব্যাপী শরী‘আত নির্ধারিত পশু কোরবানি করে থাকেন।

শিক্ষণীয় বিষয়াবলী :
(১) ইব্রাহিম (আ.) কে আল্লাহ স্বপ্নাদেশ করেছিলেন, সরাসরি আদেশ করেননি। এর মধ্যে পরীক্ষা ছিল এই যে, স্বপ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারত। যেমন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা মহাপাপ। অধিকন্তু পিতা হয়ে নির্দোষ পুত্রকে নিজ হাতে হত্যা করা আরও বড় মহাপাপ। নিশ্চয়ই এমন অন্যায় কাজের নির্দেশ আল্লাহ দিতে পারেন না। অতএব এটা মনের কল্পনা-নির্ভর স্বপ্ন হতে পারে। কিন্তু ইব্রাহিম (আ.)  ঐসব ব্যাখ্যায় যাননি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এটা ‘অহি’। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি পরপর তিনদিন একই স্বপ্ন দেখেন। প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ জিব্রাইল মারফত সরাসরি নির্দেশ না পাঠিয়ে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠালেন কেন? এর জবাব এই যে, তাহ’লে তো পরীক্ষা হত না, কেবল নির্দেশ পালন হত। 

ইব্রাহিম (আ.) কে তার স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলার জন্যই তো শয়তান মাঝপথে বন্ধু সেজে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনের সময় অহেতুক প্রশ্ন সমূহ উত্থাপন ও অধিক যুক্তিবাদের আশ্রয় নেয়া যাবে না। বরং সর্বদা তার প্রকাশ্য অর্থের উপরে সহজ-সরলভাবে আমল করে যেতে হবে।

(২) আল্লাহর মহববত ও দুনিয়াবী কোনো মহববত একত্রিত হলে সর্বদা আল্লাহর মহববতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দুনিয়াবী মহববতকে কোরবানি দিতে হবে। ইব্রাহিম (আ.) এখানে সন্তানের গলায় ছুরি চালাননি। বরং সন্তানের মহববতের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল পরীক্ষা। যদি কেউ আল্লাহর মহববতের উপরে দুনিয়াবী মহববতকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন সেটা হয়ে যায় ভালোবাসায় শিরক। ইব্রাহিম ও ইসমাঈল দু’জনেই উক্ত শিরক হতে মুক্ত ছিলেন।

(৩) পিতা ও পুত্রের বিশ্বাসগত সমন্বয় ব্যতীত কোরবানির এই গৌরবময় ইতিহাস রচিত হত না। ইসমাঈল যদি পিতার অবাধ্য হতেন এবং দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যেতেন, তাহলে আল্লাহর হুকুম পালন করা ইব্রাহিম (আ.) এর পক্ষে হয়তবা আদৌ সম্ভব হত না। তাই এ ঘটনার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সমাজের প্রবীণদের কল্যাণময় নির্দেশনা এবং নবীনদের আনুগত্য ও উদ্দীপনা একত্রিত ও সমন্বিত না হলে কখনোই কোনো উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়।

(৪) এখানে মা হাজেরার অবদানও ছিল অসামান্য। যদি তিনি ঐ বিজন ভূমিতে কচি সন্তানকে তিলে তিলে মানুষ করে না তুলতেন এবং স্রেফ আল্লাহর উপরে ভরসা করে বুকে অসীম সাহস নিয়ে সেখানে বসবাস না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী পিতা-পুত্রের এই মহান দৃশ্য অবলোকন করতে পারত না। 

বলা চলে যে, এই কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইব্রাহিম (আ.) বিশ্ব নেতৃত্বের সম্মানে ভূষিত হন। যেমন আল্লাহ বলেন,  ‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১২৪) ।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ