বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ১৬ নভেম্বর ২০২১

এক পায়েই জীবন যুদ্ধে লড়ছেন পলাশবাড়ীর রাসেল সরকার

এক পায়েই জীবন যুদ্ধে লড়ছেন পলাশবাড়ীর রাসেল সরকার

গাইবান্ধা পলাশবাড়ীর রাসেল সরকার। এপিআর এনার্জি নামের ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি পাওয়ার প্লান্টে গাড়িচালকের কাজ করতেন। ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল। অফিসের মাইক্রোবাস নিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠার সময় গ্রিনলাইন পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাস সজোরে তাঁর গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে পেছনের অংশ দুমড়েমুচড়ে দেয়। তিনি লাফিয়ে বের হয়ে প্রতিবাদ করলে তাঁর পায়ের ওপর গাড়ির চাকা তুলে দেন বাসের ড্রাইভার। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাঁ পা। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসা ও আইনি লড়াই। দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা এই ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে রাসেল ক্ষতিপূরণ হিসেবে পান ৩৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কৃত্রিম পা লাগিয়ে রাসেল ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। শুরু করেন নতুন লড়াই। ইজি বাইক মেরামত, পার্টস বিক্রির দোকান তাঁকে দিয়েছে এক নতুন জীবনের স্বপ্ন।

 

রাসেলের দোকানে

তখন ভরদুপুর। গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কে ঠুঁটিয়াপাকুড় বাজার। রাসেলের দোকান কোনটা? একজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন। কয়েক কদম এগোলেই—বিসমিল্লাহ ব্যাটারি অ্যান্ড অটো পার্টস হাউস। দোকানের সামনেই একটি ইজি বাইক। এক পায়ে দাঁড়িয়ে সেটি ঝালাই করছিলেন রাসেল। পরিচয় দিতেই দোকানের ভেতর নিয়ে বসালেন।  কেমন চলছে? জানতে চাইলে রাসেলের চোখ বেয়ে নেমে এলো কষ্টের নোনা জল। জানালেন, প্রথম দফায় সুস্থ হওয়ার কিছুদিন পরই আবার তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। পর পর তিনবার অপারেশন করতে হয়েছে। এখনো মাঝেমধ্যেই প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। বাইরে বেরোলে কৃত্রিম পা লাগিয়ে নেন। তবে দোকানে বা বাড়িতে যতক্ষণ পারেন এক পায়ে চলার চেষ্টা করেন। রাসেল বললেন, ‘মামলা করেছিলাম সড়কে এক শ্রেণির মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করতে। যেদিন আমার পা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়, সেদিনই আমি মানসিকভাবে মরে গিয়েছিলাম।’

 

রাসেল বললেন

পঙ্গু হয়ে সারা দিন বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে খুব হতাশ হয়ে পড়ি। দু-একবার মনে হয়েছিল, এ জীবন দিয়ে কী হবে? পরে পরিবারের লোকজন পাশে দাঁড়ায়। তাদের পরামর্শে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। প্রথমে বাড়ির সামনে মুদির দোকান দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে সুবিধা করতে পারিনি। আগে তো গাড়ি চালাতাম। তাই গাড়ির পার্টস আর কেনাবেচার ব্যবসাটা ভালো বুঝি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পলাশবাড়ীর ঠুঁটিয়াপাকুড় বন্দরে ঘর ভাড়া নিয়ে অটো পার্টসের দোকান দিলাম। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু টাকা এফডিআর করেছি। বাকি টাকা ব্যবসায় খাটিয়েছি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরিশ্রমের ফল পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা ব্যস্ত সময় কাটছে। কাজের মধ্যে থাকায় ভুলে থাকতে পারছি আমার একটি পা নেই। মন দিয়ে চেষ্টা করছি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। পাশাপাশি আরো পাঁচজন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি।

তবে এখনো কৃত্রিম পা লাগিয়ে যখন হাঁটি, সেই আগের দিনগুলোর কথা মনে হয়। জীবনের ওপর বড় রাগ লাগে। কিন্তু যে-ই আমার সন্তান আর পরিবারের কথা মনে হয়, তখনই প্রতিদিন নতুন করে চ্যালেঞ্জ নিই। ক্ষতিপূরণের টাকা কাজে লেগেছে। কিন্তু চিকিৎসা, অন্য খরচ ও এফডিআরের পর ব্যবসার আরো পুঁজি দরকার। ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে সাহায্য পেলে ভালো হতো।

 

পরিবারের কথা

রাসেলের বাবা শফিকুল ইসলাম আর মা রশিদা বেগম। তিন ভাই দুুই বোনের মধ্যে রাসেল মেজো। মা রশিদা বেগম বললেন, ‘দুর্ঘটনা পর রাসেলের মুখের দিকে তাকানো যেত না। ব্যবসাই ওকে রক্ষা করেছে। নিজের পরিবারকে যেমন সচ্ছল করেছে, আমাদেরও দেখছে।’ রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। তিনি বললেন, ‘রাসেল পরিশ্রম করে ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। আমরা এখন ভালো আছি।’

 

পুনর্বাসনকেন্দ্র করতে চান

নিজের পরিবারের পাশাপাশি রাসেল ভাবছেন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষের কথা। ভবিষ্যতে একটি পুনর্বাসনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবেন বলে জানালেন রাসেল। যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত সহায়-সম্বলহীন মানুষের থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। তাঁর ভাষায়, ‘প্রতিবাদ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। কিন্তু দুর্ঘটনায় আহত মানুষগুলোরও তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ