জেলা প্রশাসনের পটভূমি
বলা হয়ে থাকে যে মহাভারত রচনার প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে (বর্তমান) গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় এক হিন্দু রাজার প্রাসাদ ছিল। তাঁর নাম ছিল রাজাবিরাট। ঘাঘট নদীর তীরবর্তী এ ভূখন্ড (বর্তমান গাইবান্ধা শহর) ছিল তার রাজত্বভুক্ত পতিত তৃণভূমি। তিনি এই তৃণভূমিকে গোচারণ ক্ষেত্র ও গাভীর বাথান হিসাবে ব্যবহার করতেন। এখানে গাভীগুলো বাঁধা থাকতো বলে এ অঞ্চলের নাম হয়ে যায় গাইবান্ধা।
আবার অনেকই মনে করেন, গাইবান্ধা নামটি রাজা বিরাটের সময় প্রচলিত ছিল না। মোশারফ হোসেন প্রণীত দিনাজপুরের ইতিহাস গ্রন্থের ১০ পৃষ্ঠায় ঐতিহাসিক বুকাননের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজাবিরাট কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পঞ্চ পান্ডবের পক্ষালম্বন করে সপুত্রক নিহত হন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালে (হিন্দু পঞ্জিকা)। অথচ ‘‘গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য শীর্ষক’’ বইয়ের ১০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে সম্রাট আকবরের শাসনামলে প্রণীত ‘‘আইন-ই আকবরী’’ গ্রন্থে তৎকালীন ঘোড়াঘাট সুবা’র আওতায় মোট ৮৪ টি মহালের বর্ণনা পাওয়া যায়। এ সবের মাঝে বালকা(বেলকা), বালাশবাড়ী(পলাশবাড়ী),তুলশীঘাট, সা- ঘাট /সেঘাট(সাঘাটা), কাটাবাড়ী ইত্যাদি নাম থাকলেও গাইবান্ধা বলে কোন মহালের নাম উল্লেখ নেই। এ থেকে বোঝা যায় যায় যে, শোড়শ শতাব্দীতেও গাইবান্ধা নামটির উদ্ভব ঘটেনি। সুতরাং, রাজাবিরাটের গো-চারণ ভূমি থেকে ‘‘গাইবান্ধা’’ নামটির উদ্ভব হয়েছে এরূপ ধারণা যথার্থ নয়।
সত্যিকার অর্থে গাইবান্ধা নামটি খুব প্রাচীন নয়। হয়তবা এতদাঞ্চলের কোন ব্যক্তির গাই বাধাঁর বিশেষ কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে লোকেরা এ অঞ্চলকে গাইবান্ধা বলে ডাকতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা এ অঞ্চলের নাম হিসেবে পরিগণিত হয়। যেমন- হাতীবান্ধা, মহিষবান্ধা,বগবান্ধা এ জাতীয় আরো স্থানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জেলা হিসেবে গাইবান্ধা
১৮৭৫ ইং সালের পূর্বে গাইবান্ধা নামে এতদাঞ্চলে তৎকালীন সরকারের কোন ইউনিট ছিল না। রংপুর জেলায় সাদুল্যাপুর ও ভবানীগঞ্জ থানা নিয়ে ১৮৫৮ সালে ২৭শে আগষ্ট ভবানীগঞ্জ নামে একটি মহকুমা গঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে ভবানীগঞ্জ মহকুমা নদীভাঙ্গনের কবলে পড়লে মহকুমা সদর ঘাঘট নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধা নামক স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে এর নাম পরিবর্তন করে গাইবান্ধা মহকুমা নামকরণ করা হয়। আশির দশকে মহকুমা গুলোকে জেলায় রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ১৯৮৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী গাইবান্ধা জেলায় রূপান্তরিত হয় ।
আয়তন ও অবস্থান: সাতটি উপজেলা নিয়ে গাইবান্ধা জেলা গঠিত। উপজেলা গুলো হচ্ছে- (১) গাইবান্ধা সদর, (২) সুন্দরগঞ্জ, (৩) সাদুল্যাপুর, (৪) পলাশবাড়ী, (৫) গোবিন্দগঞ্জ, (৬) ফুলছড়ি ও (৭) সাঘাটা। এর আয়তন ২১৭৯.২৭ বর্গ কিলোমিটার ।
উত্তর বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী জনপদ গাইবান্ধা জেলা ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে ২৫ ডিগ্রী ৩ ইঞ্চি থেকে ২৫ ডিগ্রী ৩৯ ইঞ্চি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ ডিগ্রী ১২ ইঞ্চি থেকে ৮৯ ডিগ্রী ৪২ ইঞ্চি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। সমুদ্র সমতল হতে ২১.৩৫ মিটার উচ্চে গাইবান্ধা জেলা অবস্থিত। গাইবান্ধা জেলার উত্তরে তিস্তা নদী এবং কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলা। উত্তর পশ্চিমে রংপুর জেলার পীরগাছা। পশ্চিমে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর,পীরগঞ্জ উপজেলা ও দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা । দক্ষিণ পশ্চিমে জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা। দক্ষিণে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ ও সোনাতলা উপজেলা এবং পূর্ব পার্শ্বে বহমান ব্রহ্মপুত্র নদ ।
ভূ-প্রকৃতি: ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ পূর্বাংশের কয়েকটি ইউনিয়ন বাদ দিলে প্রায় সমগ্র গাইবান্ধা জেলা ‘‘নবীণ ভূ-তাত্ত্বিক যুগের প্লবণ সমভূমি’’র শ্রেণীভুক্ত। অপরাপরাংশ প্লায়স্টোসিন যুগে সৃষ্ট বরেন্দ্র ভূমির অংশবিশেষ যা স্থানীয়ভাবে ‘‘খিয়ার’’ এলাকা নামে পরিচিত।
ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: গাইবান্ধা জেলার অধিকাংশ ভূমি নদী বাহিত পলি মাটি দ্বারা গঠিত। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ‘‘খিয়ার’’ অঞ্চলের এঁটেল মাটি ছাড়া প্রায় সমগ্র গাইবান্ধা ‘‘বেলে-দোআঁশ’’ প্রকৃতির মাটিতে গড়া।
দৈনিক গাইবান্ধা