মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ || ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ৭ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ২৩:৫৮, ১২ নভেম্বর ২০২৩

কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে লাল তীর সিড

কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে লাল তীর সিড

নতুন জাতের শাবসবজি উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও বীজ উৎপাদন; বিশেষ করে সবজি বীজে গত এক দশকে বাংলাদেশে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে তার নেতৃত্বে রয়েছে লাল তীর সিড। আর যার নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠানের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে তিনি আবদুল আউয়াল মিন্টু। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানসম্পন্ন শাকসবজি বীজ সরবরাহ করে থাকে লাল তীর। মানসম্পন্ন বীজ সরবরাহে এই প্রতিষ্ঠানটির সুনাম এখন কৃষকের ঘরে ঘরে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও লাল তীরের বীজ রফতানি হচ্ছে এবং শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (ঝউএ) শর্তপূরণে বিশ্বব্যাপী বীজ উদ্ভাবন, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও সরবরাহে বেসরকারি খাতের অবদান মূল্যায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দ্য ওয়ার্ল্ড বেঞ্চমার্কিং অ্যালায়েন্স (ডইঅ); যাতে অর্থায়ন করেছে ডাচ, ডেনিশ, ব্রিটিশ, সুইডিশ ও জার্মান সরকার। ২০২১ সালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৯ দেশের প্রাক-বাছাইপূর্বক ৩১টি প্রভাবশালী বীজ প্রতিষ্ঠানের (১৩টি বৈশ্বিক ও ১৮টি আঞ্চলিক) মূল্যায়নে লাল তীর সিড ৭ম স্থান অর্জন করেছে। সম্প্রতি দেশের বীজ সেক্টরসহ কৃষির নানা দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন, দেশের সফল ব্যবসায়ী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও মাল্টিমোড গ্রুপের সিইও আবদুল আউয়াল মিন্টু। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক কাওসার আজম

নয়া দিগন্ত : বীজ ব্যবসায় লাল তীর সিডের শীর্ষস্থানে আসার ক্ষেত্রে আপনি নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন; সে ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা যদি বলেন

আবদুল আউয়াল মিন্টু : বীজ শিল্পে সফল হতে গেলে বিনিয়োগ ফেরত পেতে তাড়াহুড়া করা যাবে না। যেকোনো একটা খাদ্যশস্যের নতুন জাত উদ্ভাবন করতে ন্যূনতম ৮ থেকে ১২ বছর প্রয়োজন। নতুন জাত উদ্ভাবনে বিনিয়োগ ছাড়াও প্রয়োজন নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিনিয়োগ পুনরাবর্তনে ধৈর্য। নতুন জাত উদ্ভাবনে আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে এই জাত যেন কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। অন্য দিকে আবার নতুন জাতের এই ফলন ভোক্তার কাছে সমাদৃত বা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এক কথায় নতুন জাত যেন কৃষকের জন্য লাভজনক হয়। অন্য দিকে ভোক্তার জন্য তা স্বাদে ও গন্ধে ভালো হতে হবে। এই তিনটির সমন্বয় করে একটি নতুন জাত বা বীজ উদ্ভাবন করতে ন্যূনতম ৮ থেকে ১২ বছর লেগে যায়। এতে বিনিয়োগ থেকে লাভ করতে অনেক সময় লেগে যায় কিন্তু এত ধৈর্য কেউ রাখতে চায় না।

নয়া দিগন্ত : দেশে শাকসবজির উৎপাদন তো বাড়ছে, সেটি কী যথেষ্ট, আর জমি তো কমছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : আমার বীজ ব্যবসার শুরুতে, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে এক দিকে শাকসবজির উৎপাদন ও প্রাপ্যতা ছিল প্রয়োজনের চেয়ে কম, অন্য দিকে মান ছিল খুবই খারাপ। তখন শাকসবজির (বিঘাপ্রতি) উৎপাদনশীলতা ছিল অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। তা ছাড়া বাংলাদেশে শাকসবজির ৭০ শতাংশ উৎপাদন হতো নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ চার মাসের মধ্যে। বাকি আট মাসে পর্যাপ্ত সবজি পাওয়া যেত না। উৎপাদনশীলতা বা ফলন কম হওয়ায় দেশের গুটিকয়েক জেলায় শাকসবজির উৎপাদন হতো। তখন আমরা প্রথম বেসরকারি খাতে নতুন জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রমে বিনিয়োগ শুরু করি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী একজন মানুষকে দৈনিক ২৫০ গ্রাম শাকসবজি খাওয়া উচিত। ওই সময়কালে দেশে জনপ্রতি শাকসবজি উৎপাদন হতো মাত্র ৪২-৪৫ গ্রাম। বর্তমানে সরকারের তথ্যানুযায়ী জনপ্রতি প্রাপ্যতা হলো ৯০-১০০ গ্রাম। তবে আমার ধারণা প্রকৃতপক্ষে জনপ্রতি ৭৫-৮০ গ্রাম শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে। ২৫০ গ্রাম যদি চাহিদা ধরেন, তা হলে দেশে শাকসবজির আবাদ আরো অনেক বাড়াতে হবে। এটি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য জরুরি।

নয়া দিগন্ত : কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আপনার পরামর্শ কী, আর কিভাবে কৃষিকে লাভজনক করা যায়?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : কৃষি পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে দুটো পদ্ধতি আছে। প্রথম, আবাদি জমি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়, একই জমিতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে; অর্থাৎ একই জমিতে একই পণ্য বেশি উৎপাদন করতে হবে। আমাদের দেশে জমি বাড়ানোর কোনো সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই, বরং দিন দিন দেশে নদীভাঙন, নগরায়ন, শিল্পকারখানা, যত্রতত্র বাড়িঘর উঠানো, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও লবণাক্ততার আগ্রাসনে আবাদি জমির পরিমাণ প্রতি বছর ১-১.২ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, মিয়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়ার মতো দেশ জমির পরিমাণ বাড়াতে পারে, কারণ তাদের অনেক খালি জায়গা আছে। কিন্তু আমাদের তেমন খালি জায়গা নেই। উল্টো আবাদি জমি কমে যাচ্ছে বিধায় একমাত্র পথ হলো কৃষিতে একরপ্রতি ফলন বাড়ানো। আর এটি বাড়াতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সেটি একমাত্র সম্ভব গবেষণা ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করার মাধ্যমে। অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তাই কৃষির উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়িয়ে কৃষিকে লাভজনক করতে হবে। সেটি করার একমাত্র পথ হলো উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য গবেষণা কার্যক্রম ও নতুন জাতের উন্নতমানের বীজ।

নয়া দিগন্ত : সে ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : বীজ হলো কৃষি উৎপাদনের প্রধান ও মৌলিক উপকরণ। জমিতে ফসল উৎপাদনে কৃষক যতই সার, কীটনাশক ও পানি ব্যবহার করুক না কেন, যত টাকা খরচ করুন, যত শ্রমই দেয়া হোক না কেন, বীজ ভালো না হলে উৎপাদন কখনো ভালো হবে না। সে জন্য একরপ্রতি ফলন বাড়াতে হলে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন, যেসব জাত ফলন বেশি দেবে। তাতে কৃষক লাভবান হবে এবং উৎপাদনে উৎসাহিত হবে। একই সাথে সেটি হতে হবে ভোক্তার কাছে স্বাদে ও গন্ধে সমাদৃত। এসবের সমন্বয়ে যদি নতুন জাত উদ্ভাবন করা না হয়, তা হলে কৃষক ওই জাতের বীজ ব্যবহার করে উৎপাদন করতে আগ্রহী হবে না। অতএব নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যেটার ফলন বেশি হবে। একই সাথে নতুন জাত হতে হবে রোগ প্রতিরোধক এবং দেশের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী।

নয়া দিগন্ত : সে ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে কৃষির উন্নয়নে, বিশেষ করে গবেষণা কার্যক্রমে বেসরকারি খাতকে সরকার সহযোগিতা করে না। একমাত্র বাংলাদেশ যেখানে সরকার কোনো সহযোগিতা করে না; বরং অনেক সময় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তবে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রাণবন্ত উদ্যোক্তারা নিজে নিজেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদি অন্য দেশের মতো সরকারি সহায়তা পাওয়া যেত, তা হলে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন জাত উদ্ভাবনের গতি আরো বাড়ত। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করলেই যে বাজারজাত করা যাবে, তা নয়। আমরা প্রথমে নতুন জাত উদ্ভাবন করি। তার পর ওই জাতের বীজ উৎপাদনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। অনেক সময় নতুন জাত উদ্ভাবনের পর আরো দু-তিন বছর প্রয়োজন হয় যথাযথ বীজ উৎপাদন করতে। যেমন লাল তীর একটি পেঁপের জাত (বাবু) উদ্ভাবন করেছে ২০০৯ সালে, যা কৃষকের ও ভোক্তা উভয়ের কাছে সমাদৃত। কিন্তু এখনো আমরা দেশের চাহিদানুযায়ী বীজ উৎপাদন করতে পারছি না। ভালো বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গার মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগী কি না তার জন্য গবেষণা চালাতে হয়। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেশের কোন জেলায় কোন খাদ্যশস্যের কোন জাতের বীজ উৎপাদন সম্ভব, সেটি নির্ধারণ করা হয়।

নয়া দিগন্ত : ভালো বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণে লাল তীর কিভাবে কাজ করছে?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : বীজ উৎপাদন করার মানেই উন্নতমানের বীজ নয়। উৎপাদিত বীজকে যথাযথভাবে প্রক্রিয়াজাত করা আবশ্যক। যেমন শুকানো, বাছাই করার মাধ্যমে শ্রেণিবিভাজন করা এবং যথাযথভাবে গুদামজাত করা। কোনো কোনো বীজ দুই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত রাখতে হয়, সে জন্য উন্নত প্রযুক্তির গুদাম থাকতে হয়। বীজ হলো জীবন্ত উপাদান। তাই বীজকে জীবন্ত রাখতে হবে। মরে গেলে অঙ্কুরোদগম হবে না। তাই নতুন জাতের উদ্ভাবন, আবহাওয়া ও মাটির সাথে খাপ খাওয়ানো, বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের পাশাপাশি সংরক্ষণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটি খুবই ব্যয়বহুল। কেননা গুদামে তাপ ও আর্দ্রতার সমন্বয় থাকতে হবে। আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার সমন্বয়হীনতা হলে সেটি হবে বীজ সংরক্ষণের জন্য অনুপযোগী এবং তাতে বীজ জীবন্ত থাকবে না। তাই বীজ উদ্ভাবন থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। লাল তীর সেটিই ২৫ বছর ধরে করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়া আমূল পরিবর্তনে এখন শুধু চলতি বছরের প্রয়োজনমাফিক বীজ সংরক্ষণ রাখলে হবে না। পরবর্তী দুই বছরের যে চাহিদা তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বীজও সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। কারণ ঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে আজকাল প্রায়ই কোনো না কোনো এলাকায় বীজ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতএব যথাসময়ে কৃষক বীজ পেতে যেন কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য দীর্ঘমেয়াদে বীজ সংরক্ষণ করা এখন জরুরি। তাতে বিনিয়োগের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের ১৪টি তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত বীজ সংরক্ষণের গুদাম আছে। সম্প্রতি আরো ৬টি গুদাম নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছি।

নয়া দিগন্ত : লাল তীরে কতজন শ্রমিক কাজ করছে?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : গাজীপুরের বাসনে আমাদের লাল তীরের মোড়কজাত কার্যক্রমে চার শ’র মতো নারীশ্রমিক কাজ করেন। মোড়কজাত যদি প্যাকিং মেশিন দিয়ে করা হয় তা হলে তাদের চাকরি চলে যাবে। আমরা সব কিছু বিবেচনায় গুণগতমান ধরে রেখে প্রযুক্তির পরিবর্তে নারীদের কর্মসংস্থান করছি। লাল তীরের টার্গেট কী, জানতে চাইলে মিন্টু বলেন; আমাদের টার্গেট বা উদ্দেশ্য অতি সাধারণ; যেমন- একরপ্রতি ফলন বাড়িয়ে কৃষিকে লাভজনক করা, যাতে কৃষকের আয় বাড়ে। ফলন বেশি হলে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি হবে না, দাম কম থাকবে। তাতে মানুষ শাকসবজি বেশি ক্রয় ও খেতে পারবে। এতে মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। দেশে খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত হবে। এককথায় দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানো। একই সাথে লাল তীর যেন উন্নতমানের বীজ বিদেশে রফতানি করতে পারে। আজকাল বিদেশেও আমাদের বীজের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এখন আমরা ওমান, সৌদি আরব, পাকিস্তান, উগান্ডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করছি।

নয়া দিগন্ত : লাল তীর নিয়ে আপনার স্বপ্নটা যদি বলেন

আবদুল আউয়াল মিন্টু : দেশে এখনো প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ বৃহদাংশ জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা কৃষিনির্ভর। ক্ষুদ্র কৃষকদের পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পারিবারিক আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রথমে আমরা গবেষণা শুরু করেছি শাকসবজি দিয়ে। এরপর ধানের জাত উন্নয়নে গবেষণা শুরু করি। এখন গুরুত্ব দিচ্ছি তেল ও ডাল জাতীয় ফসলে। যেমন সরিষা, বাদাম, সয়াবিন ও সূর্যমুখী। এ ছাড়াও ডালজাতীয় ফসল- যেমন দেশে ছোলা, মসুর ডালসহ ৮-৯ রকমের ডাল উৎপাদন হয় এবং চাহিদা আছে। এর ৭০-৮০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো একই জমিতে যেন বেশি ফসল উৎপাদন করা যায় সেই ধরনের জাত উদ্ভাবন করা। একই সাথে উন্নত জাতের ফলন যেন স্বাদে-গন্ধে ভোক্তার কাছে সমাদৃত হয়। ভালো ফলনের জন্য ভালো বীজ ব্যবহার করতে হবে। সেটি যে কোম্পানির বীজই হোক। তাই আমরা অদূর ভবিষ্যতে ডালজাতীয় ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনে গবেষণাকার্যক্রম শুরু করেছি। বিদেশ থেকে বীজ এনে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যাবে না। কারণ ওই দেশে উদ্ভাবিত জাত বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটির পুরোপুরি উপযোগী না-ও হতে পারে। একই সাথে বর্তমানে লাল তীর বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে পশুসম্পদ উন্নয়নে, যাতে দেশে দুধ ও গোশতের উৎপাদন বাড়ানো যায়। ২০০৬ সালে আমরা পশুসম্পদ উন্নয়নে প্রজনন ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু করি। আমরা এখন দেশে উন্নতমানের গরু ও মহিষের জাত উন্নয়নে সক্ষম হয়েছি। প্রতি মাসে আমরা ৩০-৬০ জন কৃত্রিম প্রজননকারী টেকনিশিয়ানদের ট্রেনিং দিয়ে মাঠে পাঠাচ্ছি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত হয়ে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে এ ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রজননকারী লোক না দেয়া পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলতে থাকবে। এখন পর্যন্ত আমরা পশুসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ থেকে ৬৫-৭০টি উন্নত জাতের ষাঁড় (ইঁষষ) নিবন্ধন পেয়েছি। এ বছর থেকে আমরা ছাগল ও ভেড়ার জাত উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করব।

নয়া দিগন্ত : দেশে খাদ্যচাহিদা ও উৎপাদন নিয়ে দুই ধরনের তথ্য দেখা যায়।

আবদুল আউয়াল মিন্টু : সরকার দিনরাত বুলি আওড়ায় যে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিসে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ আজ পর্যন্ত আমার কাছে বোধগম্য নয়। চাল, গম, ভুট্টা, ডাল, তেল, মরিচ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মসলাসহ সবই আমদানিনির্ভর। একমাত্র লবণ ও আলু আমদানি করতে হয় না। তবে যে জাতের আলু দেশে উৎপাদন করা হয় সেটা বেশির ভাগই সবজির মতো। বিবিএসসহ সরকারি কৃষি বিভাগের সব তথ্য ও পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিমূলক। দেশে চালের চাহিদা তিন কোটি ৬০ লাখ টন। সরকারি তথ্যানুযায়ী উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। অথচ প্রতি বছর ৬ থেকে ৮ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়। গমের চাহিদা ৮০ লাখ টন। সরকার বলে ১০ লাখ টন উৎপাদন করছি। আমদানির পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে প্রকৃতপক্ষে আড়াই থেকে তিন লাখ টনের বেশি গম উৎপাদন হয় না। ভুট্টার চাহিদা ৮০ লাখ টন। আমরা উৎপাদন করি মাত্র ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন। তার মানে আমাদের ২০ লাখ টনের বেশি আমদানি করতে হয়। তবে ভুট্টা বাংলাদেশে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। মূলত পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তেল-ডালসহ সব খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। এরপরও দিনরাত প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে সরকারি দলের নেতারা নিত্য-নিয়ত গলাবাজি করে যাচ্ছে যে, ‘আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্র্ণ।’ দেশে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে ধানের উৎপাদন ০.৬-০.৮ শতাংশ হারে বাড়ছে প্রতি বছর। তাও যদি আবহাওয়া ভালো থাকে। সরকারি পরিসংখ্যান বিশ্বাস করলে প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৬ শতাংশ হারে। এতে বোঝা যায় যে জনসংখ্যার সাথে সঙ্গতি রেখে চালের উৎপাদন বাড়ছে না। তবে নগরায়ণ ও জীবনমান উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চালের চাহিদা দিন দিন কমবে। কিন্তু অন্যান্য খাদ্য-পণ্যের চাহিদা বাড়বে; যেমন গম, তেল, ডাল, মসলা ইত্যাদি। ভবিষ্যতে যদি কৃষি গবেষণাকার্যক্রম ত্বরান্বিত করা না হয় এবং বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন না করি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিটি খাদ্যপণ্য সরবরাহের জন্য আমদানিনির্ভরতা বাড়বে এবং দেশ খাদ্যসঙ্কটে পড়বে। যেহেতু চাল, গম ছাড়া বাকি সব খাদ্যপণ্য বেসরকারি খাত কর্তৃক উৎপাদিত বা আমদানি করা হয়, সরকারের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সঙ্কট সৃষ্টি করে। ফলে প্রায়ই দেশে কিছু কিছু খাদ্যপণ্য সরবরাহের ঘাটতি দেখা দেয় এবং সেগুলোর হঠাৎ করে দাম বেড়ে যায়।

নয়া দিগন্ত : বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে হাইব্রিড ধানের ভবিষ্যৎ কী, সরকারের কী করা উচিত?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : চীনে মোট উৎপাদনের ৭৩ শতাংশ হাইব্রিড জাতের ধান, ভারতে প্রথম দিকে ধীরগতিতে হলেও বর্তমান উৎপাদনের ৪০ শতাংশ হাইব্রিড জাতের। অথচ বাংলাদেশে এখনো মাত্র ৮-৯ শতাংশ হাইব্রিড ধান উৎপাদন হয়। কম হওয়ার বহুমুখী কারণ রয়েছে, যেমন প্রথম দিকে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত হাইব্রিড ধানের যে জাতটি কৃষককে আবাদের জন্য দেয়া হয়, সেই ধানের চালে এমিলোসের মাত্রা কম থাকায় ওইসব জাত কৃষক ও ভোক্তার নিকট সমাদৃত হয়নি। লাল তীর বর্তমানে নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে হাইব্রিড ধানে এমিলোসের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তুলনামূলকভাবে উপশী জাতের ধান যেমন ব্রি২৮ বা ২৯ থেকে হাইব্রিড জাতের ধান ১৫-২০ শতাংশ ফলন বেশি হয়। তা ছাড়া ব্রি২৮, ২৯ ধান উৎপাদনে প্রয়োজন ১৪০-১৫০ দিন। হাইব্রিড ধানের বহু জাত আছে যেগুলো ১০৫ থেকে ১১০ দিনে কাটা যায়। যদি ৯০-৯৫ দিন জীবনকালের ধান উদ্ভাবন করা যায়, তাহলে হাওর এলাকায় আগাম বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। তিনি বলেন, হাওরে এপ্রিলের ২০-২৫ তারিখের দিকে পানি আসে এবং বন্যার পানিতে ধানের ক্ষতি হয়। যদি ১০-১৫ দিন আগে ফসল তোলা যায় তাহলে আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে। একইভাবে আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে যদি লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করা যায় তাহলে দক্ষিণাঞ্চলের বহু এলাকায় ধানের আবাদ করা যাবে। আমরা বর্তমানে ইরি, ব্রি ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ওই ধরনের স্বল্পমেয়াদি জাত উদ্ভাবনে কাজ করছি। সত্যি বলতে গেলে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন দেশী জাতের ধান উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বিআর ২৮, বিআর ২৯ এগুলো সবই বিদেশী জাত। ইরি (ওজজও) থেকে নতুন উদ্ভাবিত জাত নিয়ে এসে ট্রায়াল দিয়ে ব্রি এগুলো রিলিজ করে। আমরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, গবেষণা ও প্রজননের মাধ্যমে দেশী জাতের ধান উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছি।

নয়া দিগন্ত : সে ক্ষেত্রে লাল তীর বা অন্য প্রাইভেট কোম্পানিগুলো কী করছে বা কী করা উচিত?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : ফলন না বাড়লে কৃষক সেটা চাষ করবে না। স্বাদে গন্ধে পছন্দ না হলে ভোক্তা সেটা কিনবে না। সুতরাং শুধু ফলন বেশি হলে লাভ নেই, ভোক্তা যদি না কেনে? এজন্য ফসলের জাত উদ্ভাবনে ১০-১২ বছর লেগে যায়। প্রথম ৩-৪ বছর লাগে নতুন জাতের মাতা-পিতা চিহ্নিত করতে। যাতে ফলন ছাড়াও স্বাদ, গন্ধ ও যে ধরনের রঙ পছন্দ করেন সেই বৈশিষ্ট্য আনতে। এই ধরনের বৈশিষ্ট্য আনতে প্রয়োজন ন্যূনতম ৭-৮ বছর। তবে কোনো কোনো শস্যে আরো বেশি সময় প্রয়োজন; যেমন পেঁয়াজ। পেঁয়াজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে একত্রে এনে সমন্বয় করতে অনেক সময় লেগে যায়। যেমন পেঁয়াজের ফলন বৃদ্ধি করা ছাড়াও ঝাঁজ হতে হবে বেশি, পানির মাত্রা থাকতে হবে একেবারেই কম, যাতে সহজে সংরক্ষণ করা যায়, রঙ হতে হবে সোনালি ইত্যাদি। এসব কারণে পেঁয়াজের যথাযথ হাইব্রিড বীজ উদ্ভাবনে আমাদের বিজ্ঞানীদের প্রায় ১৪ বছর লেগেছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে গবেষণা কার্যক্রমে নতুন নতুন আণবিক প্রযুক্তি প্রয়োগে সময় অনেক কমে যাবে।

নয়া দিগন্ত : লাল তীর সিডের শাকসবজি বীজ তো এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : আমরা সব ধরনের শাকসবজির বীজই রফতানি করছি। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, পাকিস্তান, উগান্ডা, নেপাল, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকাতেও পাঠানো হচ্ছে, তবে, সেটা পরিমাণে কম। ওমান, কাতার ও সৌদি আরব লাল তীর সবজি বীজের প্রধান বাজার হয়ে উঠছে। যেহেতু সেখানে বহু বাংলাদেশী আছে। তাদের চাহিদা পূরণের সাথে ওই দেশের জনগণের জন্য শাকসবজি সরবরাহে উৎপাদন করছে। ২০২২ সালে লাল তীর কর্তৃক বীজ রফতানির মূল্য ২ মিলিয়ন ডলার (১৮-২০ কোটি টাকা) ছাড়াবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, আজকাল আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে বীজ উৎপাদনে সমস্যা হচ্ছে। করলা, চিচিঙা, লাউসহ সব সবজি বীজের প্রায় শতভাগই বাংলাদেশে উদ্ভাবন এবং উৎপাদন করা হয় এবং ডিলারের মাধ্যমে কৃষকদের সরবরাহ করে থাকি। তবে কিছু কিছু পণ্যের বীজ যেমন পেঁয়াজ, গুণমান ঠিক রাখার জন্য দেশের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আমেরিকায় উৎপাদন করা হয়। কোল্ড ক্রপ বা শীতের দেশে উৎপাদিত শাকসবজি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, তরমুজ, ব্রকলি ইত্যাদি আবহাওয়াজনিত কারণে বাংলাদেশে মানসম্মত বীজ উৎপাদন সম্ভব নয়।

এতদসত্ত্বেও ইতোমধ্যে আমরা দেশে ফুলকপির জাত উদ্ভাবন ও বীজ উৎপাদন করছি। আমাদের লক্ষ্য একটাই, ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা। যে জাতের বীজ ব্যবহারে কৃষক লাভবান হবে এবং ফলন ভোক্তার কাছে স্বাদে-গন্ধে সমাদৃত হবে। কৃষক যা উৎপাদন করবে তা যেন বিক্রি করতে পারে। এর মাধ্যমে দেশে শাকসবজির চাহিদা নিশ্চিত করা; যাতে করে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প
আবদুল আউয়াল মিন্টুুর জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে ফেনীতে। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, মাল্টিমোড গ্রুপের চেয়ারম্যান। আবদুল আউয়াল মিন্টুু ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে এসএসসি ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর মার্কেন্টাইল মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম থেকে ১৯৬৮ সালে নৌবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবং একই বছর কাপ্তান হওয়ার স্বপ্নে পাকিস্তানি জাহাজে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। মিন্টু বলেন, জাহাজের নাবিক হিসেবে তিন বছর চাকরিকালে প্রথমে ক্যাডেট এবং পরে ফোর্থ এবং থার্ড অফিসার হিসেবে উন্নীত হওয়ার পর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। ওই সময় সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলেন, জাহাজটি ছিল আমেরিকার বাল্টিমোর বন্দরে। তার আগে আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলার লোবিতো বন্দরে দুই মাস ইঞ্জিন সমস্যায় আটকা পড়েছিল। সেখান থেকে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। যুদ্ধের প্রারম্ভেই পাকিস্তানি জাহাজের চাকরি ত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার পরপরই ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত সবাই তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক থেকে সামুদ্রিক পরিবহন বিজ্ঞানে বিএসসি ডিগ্রি ও ১৯৭৭ সালে পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে কৃষি ব্যবসা শুরু করার পর সোয়াচ (ঝঙঅঝ), ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে কৃষি অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সর্বশেষ ২০২২ সালে তৃতীয়বারের মতো কুইন্স মেরি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইনবিদ্যায় (আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক আইন) মাস্টার্স ডিগ্রি (এলএলএম) অর্জন করেন।

নয়া দিগন্ত : দেশে ফিরে ব্যবসায়ী হওয়ার গল্পটা যদি বলেন।

আবদুল আউয়াল মিন্টু : ১৯৭৩ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জনের পর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে একটি জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে এসে বিয়ে করি। সেখানেই বড় ছেলে তাবিথ আউয়াল ও মেজো ছেলে তাফসির আউয়ালের জন্ম। ১৯৮২ সালে সপরিবারে দেশে ফিরে আসি। ফিরে আসার পর মূলত শিপিং ব্যবসা শুরু করি। শিপিং ব্যবসা বলতে বাংলাদেশে কোনো জাহাজ ব্যবসা নয়। আমি যখন আমেরিকায় চাকরি করতাম তখন প্রায় সব আমেরিকান শিপিং কোম্পানির সাথে পরিচয় ছিল। তখন বাংলাদেশ কোনো গম আমদানি করত না। আমেরিকার পাবলিক আইন ৪৮০ এর আওতায় সব গম বিনামূল্যে সহায়তা হিসেবে পেত। এই আইন অনুযায়ী অনুদানকৃত গমের অর্ধেক আমেরিকান জাহাজে পরিবহন বাধ্যতামূলক ছিল। সেগুলো ছিল বড় বড় জাহাজ। এক সাথে ৭০-৮০ হাজার টন গম বহন করে বাংলাদেশে আসত। ওই বড় জাহাজগুলো বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে পারত না। অতএব এই গম বহিঃবন্দরে ছোট জাহাজে খালাস করে তার পরে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে খালাস করা হতো। এটাকে বলে লাইটেনিং। সাউথ আমেরিকার পেরু থেকে আরম্ভ করে, আফ্রিকা ও এশিয়াসহ পৃথিবীর ৩৯টি দেশে এই ব্যবসা করেছি। আফ্রিকার কাজটা খুবই সমস্যাসঙ্কুল ছিল। সেখানে জাহাজ থেকে মাল খালাস করে ট্রেন ও ট্রাকে করে অন্য দেশেও পাঠাতে হতো। এই লাইটেনিং ব্যবসা আমেরিকান জাহাজের সাথে সম্পৃক্ত। আমি আমেরিকাতে লেখাপড়া করেছি, সেখানকার কোম্পানিতে চাকরি করেছি। কোম্পানিগুলোর সাথে যেমন আমার পরিচয় ছিল, অন্য দিকে এ কাজে আমার অভিজ্ঞতা ছিল। আমেরিকান জাহাজ কোম্পানির মালিকরাই আমাকে এ ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা প্রদান করেছেন। ১৯৮১ থেকে প্রথম ৫ বছর বাংলাদেশে তেমন কোনো ব্যবসা করিনি।

নয়া দিগন্ত : অন্যান্য ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার গল্প যদি পাঠকদের বলেন।

আবদুল আউয়াল মিন্টু : ১৯৮৩ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে বিনিয়োগ করি। ১৯৮৭ সালে কেঅ্যান্ডকিউ নামে একটি কার্বন রড ফ্যাক্টরি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা থেকে ক্রয় করি। তারপর ১৯৮৮ সালে নিজ জেলা ফেনীতে দুলামিয়া কটন স্পিনিং মিল স্থাপন করি। ২০০০ সালে প্রগতি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স ও ২০০৬ সালে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সসহ আরো কয়েকটি খাতের সাথে ১৯৯৫ সালে কৃষি খাতে বিনিয়োগ আরম্ভ করি। বিনিয়োগের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল গবেষণাকার্যক্রম। পরবর্তীতে শাকসবজির জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নের সাথে বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাত শুরু করা হয়। আমার জানামতে আজ বাংলাদেশে কোনো জেলায় কোনো কৃষক নেই যিনি লাল তীর চেনেন না। গ্রাম থেকেই আমার উঠে আসা। গ্রামের লোকদের সাথে মিশতে ভালো লাগে। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় ঘুরেছি। কৃষকদের সাথে মেলামেশা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনমাফিক জাত উদ্ভাবনে গবেষণাকাজ পরিচালনা করতে বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করেছি।

নয়া দিগন্ত : এখন কী নিয়ে কাজ করছে লাল তীর?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : প্রথমে আমাদের কার্যক্রম ছিল শুধু শাকসবজি উন্নয়নে। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা নজর দিয়েছি হাইব্রিড জাতের ধান উদ্ভাবনে। এখন আমরা জোর দিচ্ছি তেলবীজে; যেমন চীনা বাদাম, সূর্যমুখী, সয়াবিন, সরিষায়। যাতে আমন ও বোরো মৌসুমের মধ্যকালে তেলবীজ উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়াও আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে। নোয়াখালী, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় অনেক জমি বছরের অনেক সময়ে বিনা চাষে পড়ে থাকে। এসব এলাকায় দিন দিন লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্য অর্জনে লাল তীর বাগেরহাটে ১৫ একর জমিতে লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং আমরা গবাদিপশুর উন্নয়নে নজর দিচ্ছি। দেশের আবহাওয়া, গরিব চাষিদের ব্যবস্থাপনার মান, পশুখাদ্যের লভ্যতাকে সামনে রেখে গরু ও মহিষের নিজস্ব জাত উন্নয়ন হলো আমাদের প্রধান লক্ষ্য। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন ২৫০ মিলি গ্রাম দুধ। দুধের উৎস হলো গরু (গাভী) ও মহিষ। লাল তীরের লক্ষ্য হলো; গ্রামীণ মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং জীবনমান উন্নয়নে সহযোগী হিসেবে কাজ করা। গ্রামীণ কৃষিজীবিদের জীবনমান উন্নয়নে শাকসবজি ও ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, যাতে কৃষক নিজের উৎপাদিত পণ্য দিয়ে নিজ প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত শস্য বিক্রি করে লাভবান হয় এবং আয় বাড়াতে পারে। একই সাথে যদি গরু ও মহিষ পালন করে, তাহলে দুধ ও গোশত বিক্রি করে লাভবান হবে। তবে লাল তীর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মহিষের উন্নয়নে। বাংলাদেশে দুধের সমস্যার সমাধান করতে হলে মহিষ ছাড়া শুধুমাত্র গাভী দিয়ে সম্ভব নয়।

নয়া দিগন্ত : কেন এমন মনে হয়?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হয় ভারতে। সেই দেশে দুধের মোট উৎপাদনের ৭৩ শতাংশ আসে মহিষ থেকে। পাকিস্তান মোট দুধ উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ মহিষ থেকে। আমাদের দেশের আবহাওয়া, মহিষের জন্য ভারত ও পাকিস্তাান থেকে ভালো। মহিষের হজমশক্তি গরুর চেয়ে বেশি। রোগজীবাণু কম। অনেক বেশি গরম সহ্য করতে পারে। পশু হিসেবে মহিষ, গরু থেকে বেশি প্রশান্ত বিধায় মহিলাদের জন্য উপযোগী। মহিষ পালনে খরচ কম। মহিষ এবং গরুর দুধের রাসায়নিক চরিত্র একই। গরুর দুধে চর্বি মাত্র ৪ শতাংশ। বাকিটা পানি। আর মহিষের দুধে চর্বি ৮-১০ শতাংশ। অতিরিক্ত চর্বি বের করে ঘি বা মাখন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। দেশে মাখনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। গৃহপালিত পশু হিসেবে গরু থেকে মহিষ সুবিধাজনক। এজন্য মহিষের জাত উন্নয়নে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।

নয়া দিগন্ত : আর কী নিয়ে কাজ করছে লাল তীর?

আবদুল আউয়াল মিন্টু : বাংলাদেশে রেশম বা সিল্ক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা একটি স্বনামধন্য চীনা কোম্পানির সাথে বর্তমানে একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। বাংলাদেশে ১২০০ টন রেশম প্রয়োজন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৭০-৮০ টন রেশম উৎপাদন হয়। কিন্তু বাস্তবে ৩০ টনের বেশি নয়। দেশে উৎপাদিত রেশম তেমন মানসম্পন্ন নয়। একটা চাইনিজ পোকা থেকে ১৬০০-১৮০০ মিটার সুতা উৎপাদন সম্ভব। অথচ বাংলাদেশে হয় মাত্র ৭০০-৮০০ মিটার। গ্রামের কৃষক শাকসবজির পাশাপাশি ঘরের বা বাড়ির আশপাশে পতিত জমিতে তুঁতগাছ লাগালে বছরে ৩ বার পাতা বিক্রি করতে পারবে। সেই পাতা কিনে রেশম পোকার চাষ করার পদ্ধতি নিয়ে লাল তীর কাজ করছে। আমাদের সব পরিকল্পনাই গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার ঘিরে।

নয়া দিগন্ত : সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আবদুল আউয়াল মিন্টু : আপনাকে এবং নয়া দিগন্তকেও ধন্যবাদ।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়