বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ১ জুলাই ২০২২

পদ্মার চেয়েও বড় সেতু হবে

পদ্মার চেয়েও বড় সেতু হবে

পদ্মার চেয়েও বড় সেতু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ১০ কিলোমিটারের এ সেতুটি বিভাগীয় শহর বরিশালের সঙ্গে যোগ করবে দ্বীপজেলা ভোলাকে। ইতোমধ্যে সেতুর প্রাথমিক সমীক্ষার কাজ সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে। টাকা পেলে আগামী চার বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করা যাবে বলে আশাবাদী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সাহসিকতায় নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের পর গত ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে। এরপরই ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখছেন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দারা। যদিও এর পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল সফরকালে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে সর্বপ্রথম ভোলা-বরিশাল সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। সেই থেকেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দারা। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে এই সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণে নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার। অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এখন অর্থের উৎস খোঁজা হচ্ছে। দাতা সংস্থার সবুজ সঙ্কেত পেলেই শুরু হবে নির্মাণ কর্মযজ্ঞ।

সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বরিশাল-ভোলা সড়ক সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এখন ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। অর্থায়নের ব্যাপারে কথাবার্তা হচ্ছে। চীন অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এ সেতু নির্মাণে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সরকার বরিশাল ও ভোলাকে সংযুক্ত করতে দেশের সবচেয়ে বড় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এটা সরকারের অন্যতম মেগা প্রকল্প। তিনি আরও বলেন, সেতুটি নির্মাণের জন্য আমরা উন্নয়ন সহযোগী খুঁজছি। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ ও সংস্থাকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, এ সেতুটি নির্মিত হলে বরিশালের লাহারহাট থেকে ভোলার ভেদুরিয়া ফেরিঘাটকে সংযুক্ত করবে। সেতুতে স্প্যান বসবে ৫৮টি, অবস্থাভেদে এক একটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হবে ১১০ থেকে ২০০ মিটার। সেতুর জন্য প্রায় ১৩শ’ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।

সেতু বিভাগের এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফান্ডিং সোর্সের ওপর মূলত এ ধরনের মেগা প্রজেক্টের কাজ নির্ভর করে। তিনি আরও বলেন, দেশের দীর্ঘতম এ সেতু নির্মিত হলে ভোলায় সম্প্রতি আবিষ্কৃত গ্যাস খনির জন্য পাইপলাইন বসানো সম্ভব হবে। এছাড়া সেতুর নিচের অংশে নদীর মাঝখানের চরগুলোতে  ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার পথও সুগম হবে। পাশাপাশি দ্বীপজেলা ভোলার বাসিন্দাদের পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ ও পণ্য আনা -নেয়া সহজ হবে।

সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে শিল্প, কল-কারখানার ক্ষেত্রে গ্যাসের কোন বিকল্প নেই। তাই ভোলা-বরিশাল নৌরুটে সেতু নির্মিত হলে সহজেই গ্যাস পাবে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলবাসী। এতে করে পদ্মা সেতুর প্রকৃত সুফল বয়ে আসবে।

সূত্রমতে, পদ্মা সেতুর চেয়ে নির্মাণ ব্যয় কম হলেও বর্তমান সরকারের নতুন এ প্রকল্পটি পদ্মা সেতুর চেয়েও বড়। দ্বীপজেলা ভোলাকে বিভাগীয় শহর বরিশালের সঙ্গে যুক্ত করতে এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাবলিক- প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে তেঁতুলিয়া ও কালাবদর নদীর ওপর দিয়ে বরিশাল-ভোলা সড়কে দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ করা হবে।

সেতু বিভাগের তথ্যমতে, প্রস্তাবিত সেতুটি বাস্তবায়নের পর ভোলা জেলা থেকে সরাসরি পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। প্রস্তাবিত সেতুটি নির্মাণ হলে পদ্মা সেতুর সুবিধা আরও বৃদ্ধি পাবে।

সূত্রমতে, ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু প্রকল্পের আওতায় দুটি নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হবে। মাঝে চরের ওপর চার কিলোমিটার ভায়াডাক্ট তৈরি করা হবে। সেতু নির্মাণে আনুমানিক ১২ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও নির্মাণ শুরুর পর খরচ আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে সেতু নির্মাণের নক্সা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ সেতুটি নির্মাণ হলে ভোলা থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সেতু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেতু নির্মাণের জন্য জরিপ কাজ এবং সেতুর সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সেতুটি নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের এই দুটি জেলার মধ্যে যাতায়াতে সময় কম লাগবে এবং ভোলা থেকে গ্যাস সরবরাহ করা সহজ হবে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জরিপ ও আলোচনার ভিত্তিতে ভোলার ভেদুরিয়া ফেরিঘাট এবং বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাট বরাবর সেতুটি নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ কিলোমিটার সেতুর মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার শ্রীপুর চরের ওপর দিয়ে যাবে।

সূত্রমতে, ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্রের প্রায় ৩২ কিলোমিটার উত্তরে ভেদুরিয়া ইউনিয়নে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। এতে করে ভোলার গ্যাসের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বরিশাল বিভাগের পূর্ব অংশ ভোলা জেলাকে তেঁতুলিয়া নদী মূল ভূখ- থেকে আলাদা করে রেখেছে। প্রায় তিন হাজার চারশ’ বর্গকিলোমিটার আয়তন এবং প্রায় ২০ লাখ ৩৭ হাজার জনসংখ্যার দ্বীপজেলা ভোলার সঙ্গে বরিশালের সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। ভোলা যাওয়ার একমাত্র উপায় নদীপথ। নদীপথে বরিশাল থেকে ভোলার ভেদুরিয়া যেতে লঞ্চে প্রায় দুই ঘণ্টা এবং স্পিডবোটে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে। ভেদুরিয়া থেকে ভোলা সদর উপজেলায় যেতে আরও প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। বরিশালের লাহারহাট ফেরিঘাট থেকেও লঞ্চে ভেদুরিয়া যাওয়া যায়। এই ঘাট থেকে ভোলার ইলিশঘাট পর্যন্ত একটি ফেরি চলাচল করে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ভোলা-বরিশালের মধ্যে সেতু নির্মাণের জন্য বর্তমান সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভোলা থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন নৌকা ও লঞ্চের ওপর নির্ভরশীল। যা এই জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে। সেতুর সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, সেতুর কাজ শেষ হলে ভোলা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারীদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি হবে। তাই সেতু প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ভোলা-বরিশালের সেতুটি নির্মিত হলে গোটা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগে আসবে বিরাট পরিবর্তন। যা অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের চলমান যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এই সেতু মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা রাখবে।

বিবিএর দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা ইআরডিকে অনুরোধ করব সেতু নির্মাণের জন্য অর্থায়ন করতে আগ্রহীদের খুঁজে বের করতে। সরকারের পক্ষ থেকে ইআরডি বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে থাকে। চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া ইতোমধ্যে প্রকল্পটি অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল সেতুতে রেললাইন না থাকায় এর ব্যয় পদ্মা সেতুর চেয়ে অনেক কম হবে। তাছাড়া জরিপ বলছে, নদী শাসনের জন্য তেঁতুলিয়া নদী পদ্মার মতো কঠিন হবে না।

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভোলা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দ্বীপজেলা। এর চারপাশে লক্ষীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও বঙ্গোপসাগর। এ জেলায় রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, যা বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ভোলা জেলাটি দেশের মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। বর্তমানে ফেরি ও নৌযানের মাধ্যমে ভোলার সঙ্গে পাশের জেলাগুলোর যোগাযোগ চালু রয়েছে। সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ভোলা থেকে অন্য জেলাগুলোতে পণ্য আনা-নেয়া ও যাতায়াত বেশ কঠিন। ফলে জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

ভোলা-বরিশালে দেশের দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি নির্মিত হলে ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হবে। এতে যাতায়াত ও উৎপাদন খরচ কমবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ থাকায় ভোলা জেলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। এর ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে, যা দরিদ্রতা কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এজন্য সেতুটি নির্মাণে সরকারের সেতু বিভাগের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ