শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৬:২৯, ২০ মে ২০২২

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনির্বাণ দীপ

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনির্বাণ দীপ

চলে গেলেন অবিস্মরণীয় সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি?’ বাঙালির এই চিরকালীন শোক স্তোত্রের রচয়িতা বাঙালি রাষ্ট্রসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ গাফ্ফার ভাই আর কোনোদিন তার প্রাণবন্ত আড্ডায় আমাদের মাতাবেন না। মেলে ধরবেন না তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি থেকে বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। তুলে ধরবেন না তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ও চেতনার দীপÑযা নতুন প্রজš§কে প্রগতির পথযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করবে, অনুপ্রাণিত করবে।

‘বাংলাদেশ’ নামের এই রাষ্ট্রটি আজ তার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে শতবর্ষের অভিমুখে ধাবিত। এই রাষ্ট্রসত্তার জš§ এবং বেড়ে ওঠা যাদের চিন্তা-চেতনায়, তাদের অন্যতম একজন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তার মহাপ্রয়াণ পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে দিয়ে গেল প্রগতিশীল চেতনার উত্তরাধিকার বহনের অনিবার্য দায়িত্ব। সন্দেহ নেই, তার মৃত্যু আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।

তিনি আমাদের শোককে শক্তিতে পরিণত করার মতো অমর পঙ্ক্তিমালার কবি। তার হাতে রচিত সেই শোকসংগীত আমাদের নানা সংকটে, নানা দুর্যোগে, দুর্বিপাকে রুখে দাঁড়ানোর অনির্বাণ প্রেরণা জোগায়। কিন্তু তার মৃত্যু আমাকে ব্যক্তিগতভাবে শোকস্তব্ধ করে দিয়েছে।

একুশ শতকের সূচনালগ্নে আমরা দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশনার শুরুর দিন থেকে তার সমর্থন, আশীর্বাদ, ভালোবাসা পেয়েছি। পেয়েছি তার অমূল্য সাহচর্য। তিনি শুধু আমাদের যুগান্তরকে লেখা দিয়েই সমৃদ্ধ করেননি, তিনি তার জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে পথনির্দেশনা দিয়েছেন নিরন্তর। তার ভীষণ ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন থেকে মূল্যবান সময় বের করে প্রতি সপ্তাহে যুগান্তরের জন্য লিখেছেন তার ঐতিহাসিক কলাম ‘তৃতীয়মত’। এমন হয়েছে যে, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী অবস্থায়ও তিনি পাঠকের জন্য লিখে পাঠিয়েছেন তার কলামটি। আমরা অনেক সময় তার অসুস্থতায় কলাম লেখার কষ্ট থেকে নিবৃত্ত করতে চাইলেও তিনি তা শোনেননি। পাঠককে কেবল বঞ্চিত করার দায় নয়, পাঠকের সান্নিধ্য ছিল যেন তার কাছে এক অনিবার্য দায়বদ্ধতা।

এমনো হয়েছে, তিনি ডিকটেশন দিয়ে লিখিয়ে স্ক্যান করে ই-মেইল করেছেন তার লেখা। প্রথমদিকে তার লেখা আসত ফ্যাক্সে। পরে প্রযুক্তির কল্যাণে মেইলে তার লেখা ঠিক সময়মতো পৌঁছে যেত।

সুদীর্ঘকাল তিনি দেশ থেকে বাইরে ছিলেন কিন্তু তার লেখায় যে কোনো বিষয়ের সর্বশেষ আপডেট থাকত। অর্থাৎ তিনি তার হৃদয়ের ভেতরেই বহন করতেন সর্বক্ষণ যে সত্তাকে তার নাম- বাংলাদেশ।

২.
কত স্মৃতি তার সঙ্গে। দেশে এসে তিনি যুগান্তরে অবশ্যই আসতেন আড্ডা দিতে। যুগান্তর ছিল তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান। প্রবীণ এই প্রাজ্ঞ মানুষটি যুগান্তরে এলে তরুণতম সহকর্মী থেকে শুরু করে তার বন্ধু এবং প্রিয়জনদের মিলনমেলার প্রাঙ্গণে পরিণত হতো যুগান্তর কার্যালয়। আমাদের মতিঝিলের অফিসে তিনি অনেকবার এসেছেন। তার সঙ্গে আড্ডায় মেতেছেন যুগান্তরের প্রয়াত সম্পাদক শ্রদ্ধেয় গোলাম সারওয়ার, এবিএম মূসাসহ দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিরা। আমি তাকে এর বাইরেও পেয়েছি জাতীয় প্রেস ক্লাবের আড্ডায়। সেই আড্ডা এমন আপনতাপূর্ণ যে, তাকে ভোলা যায় না। যাকে বলে প্রাণস্পন্দিত আড্ডা, সেটাই ঘটত তার উপস্থিতিতে। যুগান্তরের অফিস মতিঝিল থেকে যমুনা ফিউচার কমপ্লেক্সে আসার পরও তিনি দেশে এলে অনেক যানজট উজিয়ে, প্রাণের অনিবারণীয় টানে আমাদের সঙ্গে আড্ডায় মিলিত হয়েছেন। অসুস্থ শরীরেও এসেছেন। এটাই ছিল তার সজীব তারুণ্য। সর্বশেষ বাংলাদেশে যেবার এসেছিলেন সেবার সময়ের স্বল্পতার কারণে তিনি যুগান্তরে আসতে পারেননি। সেই না আসতে পারার বেদনায় ফোনে আমাকে বলেছিলেন, ‘সাইফুল, এর পরের বার দেশে গেলে অবশ্যই দেখা হবে।’ আমি জানতাম আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী তার কথা রাখবেন। অবশ্যই দেখা হবে আবার ঢাকা এলে। কিন্তু না..., তিনি সেই প্রতিশ্রুতির ঊর্ধ্বে চলে গেলেন আজ। আমি সেই শোকস্তব্ধ অনুভবের মধ্যে তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

৩.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে তিন সাংবাদিক অনুজকে ‘আপদ, বিপদ, মুসিবত’ নামে ডাকতেন, সেই ত্রয়ীর শেষ ব্যক্তি আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে যেন শব্দবন্ধটি আজ শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু প্রয়াত এবিএম মূসাকে বলতেন আপদ, প্রয়াত ফয়েজ আহমদকে বলতেন বিপদ আর সদ্যপ্রয়াত আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী- আপনাকে বলতেন মুসিবত। এই কথা আপনার মুখ থেকেই শোনা- আমাদের অবিস্মরণীয় সেই আড্ডায়।

আপনারা কেউই এই দেশের জন্য আপদ-বিপদ-মুসিবত ছিলেন না- সে কথা যেমন বঙ্গবন্ধু জানতেন, তেমন আপনারাও জানতেন। আপনারা ছিলেন মূলত এ দেশের মুশকিলে আসান, আস্থা, ভরসা।

দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির হৃদয়ের কোন স্থানে অবস্থান করলে এমন হার্দিক অভিধা জোটে, আমাদের আজকের প্রজন্মের কাছে সেটা অভাবনীয়- কিন্তু আপনারা সেই হিরণ্ময় বাস্তবতার সন্তান। আপনার মৃত্যুতে তাই আমার মতো অনেকেরই মনে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের ওপর থেকে যেন একটি মমতাময় ছায়া অন্তর্হিত হলো। এই অনুভূতি শুধু আক্ষরিক নয়, আপনারা আমাদের হৃদয়ে যে শ্রদ্ধা ও স্নেহের পরম্পরা সঞ্চারিত করে গেছেন তারই স্বগত উচ্চারণ।

৪.
আমি যখন প্রেস ক্লাবের সভাপতি তখন ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে ঠিক হলো আপনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আপনি ঢাকা এসেছিলেন কিন্তু জাতীয় প্রেস ক্লাবে সে সংবর্ধনা হয়নি, কারণ আপনি ছিলেন অসুস্থ। আমি, ক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন ছুটে গিয়েছিলাম মোনায়েম সরকার ভাইয়ের শান্তিনগরের বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন খন্দকার রাশেদুল হক নবা ভাই। প্রাণের উষ্ণতায় ভরে উঠেছিল মোনায়েম ভাইয়ের বাসা। অনেকক্ষণ সেদিন সময় দিয়েছিলেন গাফ্ফার ভাই। এক গভীর আন্তরিকতায়।

প্রিয় গাফ্‌ফার ভাই, বাংলাদেশ আপনার মতো সুবর্ণ সন্তানকে ভুলবে না। আপনি আমাদের বুকের গহিনেই থাকবেন। রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে- ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম। নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমায় নিশিথিনী সম।’ আপনি থাকবেন আমাদের জীবনে, যৌবনে, আমাদের দুঃখ, বেদনায় ভরাবেন সৌরভে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনির্বাণ দীপ হয়ে যুগে যুগে।

সাইফুল আলম : সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর, সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ