বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৮:৪১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে সেচ প্রকল্প নিয়ে তোপের মুখে পাউবো

ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে সেচ প্রকল্প নিয়ে তোপের মুখে পাউবো

যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন প্রকল্প নিয়ে সেমিনারে তোপের মুখে পড়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা। জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্ভাবনী উদ্যোগের পাইলটিং কার্যক্রম নিয়ে শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে পাউবো।

সেমিনারে স্যালো মেশিনে সেচের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের নতুন উদ্ভাবনী প্রকল্প সম্পর্কে তুলে ধরা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা এ প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করে পাউবোকে লুটপাটকারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিচার দাবি জানান। একই সঙ্গে ভবদহ অঞ্চলকে লুটপাটকারীদের কাছে ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বক্তারা বলেন, ভবদহ অঞ্চলে জোয়ারাধার (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-টিআরএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়া জনগণকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।

যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রফিকুল হাসানের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চিফ ইনোভেশন কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আজাদুর রহমান মল্লিক। বিশেষ অতিথি ছিলেন পাউবোর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী একেএম তাহমিদুল ইসলাম, যশোর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পীজুষ কৃষ্ণ কুন্ডু।

কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম। এতে বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও সদর উপজেলার আংশিক এলাকার মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। এ এলাকার মুক্তেশ্বরী-টেকা-হরি নদীর সঙ্গে উজানে বড় কোনো নদীর সংযোগ নেই। যে কারণে জোয়ারের সময় প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি নদীর তলদেশে জমা হয়। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও যশোর অঞ্চলে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। নদী খনন করে জলাবদ্ধতা নিরসন টেকসই করা যাচ্ছে না। যান্ত্রিক উপায়ে সেচ পাম্পের মাধ্যমে ভবদহ এলাকার পানি নিষ্কাশন করলে জলাবদ্ধ এলাকার পানি কিছুটা কমবে। একই সঙ্গে নদীর নাব্যও বাড়বে।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে, এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও পল্লী বিদ্যুৎ যশোরের সহযোগিতায় ভবদহ ২১ ভেন্ট রেগুলেটরের উজানে ২০টি বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত উদ্যোগের পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করা হয়। উদ্যোগটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প স্থাপন করলে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করে ভবদহ জলাবদ্ধতার সমাধান করা সম্ভব হবে।

সেমিনারে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ভবদহ অঞ্চলের মানুষ কপালপোড়া। প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলছেন, নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড উল্টোপথে হাঁটছে। তারা ভবদহ এলাকার সব নদীগুলোকে মেরে ফেলেছে। এখানকার মানুষকে বাঁচাতে হলে টিআরএম ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বিলকপালিয়া থেকে টিআরএম বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে আমডাঙ্গা খাল খনন করে প্রশস্ত করতে পারলে ভবদহ অঞ্চলের মানুষ জলাবদ্ধতার হাত থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু তা না করে পানি উন্নয়ন বোর্ড লুটপাটের নতুন প্রকল্প নিচ্ছে। এখানে প্রকল্পের কোনো অনিয়মের তদন্ত হয় না।

মনিরামপুর কুলটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখর চন্দ্র বলেন, গত ৪ বছর ধরে আমাদের গ্রামে পানির কারণে ফসল হচ্ছে না। নদীকে শাসন নয়, নদীকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড জনগণ ও সরকারকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এ অঞ্চলে শুধু খনন করে নদী বাঁচানো যায় না। প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল নদী বাঁচানো সম্ভব। পাঁচ বছর ধরে কেবল নদী খনন করা হচ্ছে। এতে নদীর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে ভবদহের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ অবাস্তব এবং হাস্যকর। ভবদহ অঞ্চলকে বিরান হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে টিআরএম বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা না করে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, নদী খননের নামে অর্থ লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জনগণের দাবি মেনে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ না করলে এই এলাকা জলাবদ্ধতামুক্ত এবং বিরান হওয়া থেকে রক্ষা পাবে না।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক এনামুল হক বাবুল বলেন, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে টিআরএম বাস্তবায়ন শুরু না হলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ৪০ বছর ধরে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা কত টাকা খরচ করছেন তার হিসাব কেউ নেয় না। তাদের তামাশার কারণে আবারও ২০০ গ্রামের ১০ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হতে চলেছেন। ফসলের জমি, বসতভিটা সবই কেড়ে নিয়েছে পানি। সরকার বারবার প্রকল্প নেয়, কিন্তু জলাবদ্ধ মানুষের কোনো উপকার হয় না।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি যুগ্ম সচিব আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, সরকারের ডেল্টাপ্ল্যানে টিআরএম বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে এটি বাতিল হবে না। আমরা জনগণের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দূরত্ব দূর করতে উদ্যোগী হয়েছি। আগামীতে যে প্রকল্প নেওয়া হবে সেটি জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই করা হবে।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এ এলাকার ৫২টি বিলের পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী দিয়ে। পলি পড়ে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টি ও উজানের পানিতে এলাকার বিলগুলো প্লাবিত হয়েছে। বিল উপচে পানি ঢুকেছে সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। এরই মধ্যে অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলার ২০০ গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ