বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ || ১৩ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১২:৪২, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩

ভয়ঙ্কর তেঁতুলতলা, শতবর্ষী তেঁতুল গাছের ডাল ভাঙলেই অমঙ্গল!

ভয়ঙ্কর তেঁতুলতলা, শতবর্ষী তেঁতুল গাছের ডাল ভাঙলেই অমঙ্গল!

এক সময় গাঁ শিউরে ওঠা ভয়ঙ্কর জায়গা ছিল রাজশাহী পবা উপজেলার হরিয়াণের দহপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলা বাজার। অনেক প্রবীণও বলতে পারেননি জীবন্ত এই তেঁতুল গাছের বয়স। চার পুরুষের সবাই গাছটি একই রকম গঠন দেখেছেন। তবে কালক্রমে জায়গাটি মানুষের পদচারণা ও বসবাস শুরু হলেও এখনো তেঁতুল গাছটির ডাল ভাঙলে, গাছের পাশে প্রস্রাব করলে কিংবা তেঁতুল নামিয়ে বিক্রি করলে হয় অমঙ্গল বলে দাবি স্থানীয়দের।

তেঁতুল গাছের বিষয়ে হরিয়াণ ইউপির মেম্বার ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আক্কাস আলী বলেন, ‘আমার আব্বার আব্বাও বলতে পারেননি এই তেঁতুল গাছের বয়স কত! আমার দাদারাও শুনেছি এমনি দেখেছেন যেমনটা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’

অলৌকিকতা ও ভীতিকর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘খুব ভয়ঙ্কর জায়গা ছিল তেঁতুলতলা। ওখানে প্রস্রাব-পায়খানা তো দূরের কথা, ওই গাছের শুকনো ডাল পড়ে গেলেও কেউ কুড়িয়ে তা চুলায় দিতে ভয় পায়। দিলেই খবর আছে! এমনকি কেউ ওই গাছের তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করলেও তার খবর আছে।’

গাছের আশপাশে প্রস্রাব করে, গাছের ডাল ভেঙে আমাদের এলাকার অনেকেই বিপদে পড়েছেন। তবে কেউ যদি নিজে খাওয়ার জন্য কিংবা অন্যকে বিলানোর জন্য তেঁতুল পাড়েন তাহলে কিছু হবে না। কিন্তু ওই তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করলেই তার খবর হয়ে যাবে বলে জানান মেম্বার আক্কাস আলী।

সরেজমিন তেঁতুলতলা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, তেঁতুলগাছটি প্রায় দেড় বিঘা এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। পুরো গাছটি সবুজ পাতা ও কাঁচাপাকা তেঁতুলে ভরপুর। গাছটির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডালগুলোতে ফুটেছে নতুন ফুল ও ছোট ছোট তেঁতুল।

মূলত: শতবর্ষী তেঁতুল গাছের নাম ধরেই ‘তেঁতুলতলা’ বাজার নামকরণ হয়েছে। কেউ-ই সুনির্দিষ্টভাবে জানেন না গাছটির বয়স। এখনো গ্রামটির বাচ্চা থেকে বুড়ো বয়সে সবাই জানেন তেঁতুল গাছের গা শিউরে উঠা নানান ঘটনা।

স্থানীয়রা জানান, অনেকেই এই গাছ নিয়ে স্বপ্ন দেখলে করেন মানত। মানত করে গাছের তলায় রেখে যান দুধ, কলা, মিষ্টি, গরু, খাসি ও মুরগি। সেগুলো স্থানায়ীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।

শতবর্ষী এই তেঁতুল গাছটি তার প্রকাণ্ড ডাল-পালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে চারদিকে। এক সময় এই রাস্তায় ভয়ে কেউ যাতায়াত করতেন না। তবে কালক্রমে আশপাশে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, দোকান-পাট। তেমনি একটি ডাল প্রসারিত হয়ে রাস্তার ওপার চলে গিয়েছে। সেখান দিয়ে নির্মাণ হয়েছে একটি মার্কেট। মার্কেটের একটি দোকান রয়েছে ফাঁকা। সেই ফাঁকা দোকানটিতে ঢুকে রয়েছে তেঁতুল গাছে একটি বড় ডাল।

দোকান ঘরটির এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে ওই এলাকার বাসিন্দা সাবাজ মণ্ডল বলেন, ডাল কাটলে খবর আছে। 

তিনি বলেন, ‘আমারই এক বংশের লোক এই গাছের একটি ডাল কেটেছিলেন। কয়েকদিনের পর তার পায়ে পচন ধরে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার গোটা পা কেটে ফেলতে হয়। পরে তিনি মারা যান।’

তেঁতুল গাছের পাশেই মিল রয়েছে মাইনুল ইসলামের। ২৫ বছর ধরে চালাচ্ছেন মিলটি। তিনি বলেন, ‘আমার বাপ-দাদা এমনকি বড় আব্বারাও (বাবার দাদা) বলতে পারেননি গাছের বয়স। বহু পুরোনো গাছ এটি। এই গাছ নাড়লেই ক্ষতি, অন্যথায় কিছুই হবে না।’

তিনি প্রতিবেদককে টেনে দেখান একটি কাটা ডাল। সেই ডালটির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সুগারমিলের রহমান ড্রাইভার গাছের ডালটা কেটেছিল। তার এখন মাথার ঠিক নেই, পুরাই পাগল। গাছের বিষয়ে বললে আরো রেগে যান। তার সুগার মিলের এক নীরা মিস্ত্রি গাছ কাটতে সাহায্য করেছিলো, তারও সমস্যা হয়েছিল। পরে মাফ চেয়ে তিনি এখন ঠিক আছেন।’

তেঁতুল গাছ থেকে তেঁতুল নামানো বা বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে সাবের আলী বলেন, ‘গাছ থেকে তেঁতুল নামিয়ে খেলে কোনো সমস্যা নেই। যতখুশি পারতে পারবেন, খেতে পারবেন, বিলাতে পারবেন কিন্তু এ গাছের তেঁতুল বিক্রি করতে পারবেন না।’

তিনি বলেন, একবার এক লোক এই গাছের একটা মধুর চাক কেটেছিল। দুদিনের মধ্যে তিনি মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যান।

দিনমজুর মুকুল বলেন, তেঁতুল পেড়ে বিক্রি করায় একলোকের মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যাচ্ছিল। পরে ওই গাছের কাছে মাফ চায়, আর ভুল স্বীকার করেন। তারপর তিনি ঠিক হন। আমিও সেদিন তেঁতুল পেড়েছিলাম। কিন্তু আমি বিক্রি করিনি, তাই আমার কিছু হয়নি।’

হরিয়ান ইউপির সাবেক মেম্বার সাবের আলী মণ্ডল। বর্তমানে তেঁতুলতলা বাজারে রয়েছে তার সার ও কীটনাশকের দোকান। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাপ দাদারাও এই গাছের বয়স জানেন না, আমরা কি করে বলব বলেন! আমার বাপ দাদা ১১০-১২০ বছর বেঁচে ছিল। তারাও বলতে পারেনি গাছের বয়স। আমাদের দাদার দাদারাও বলেছেন- এই গাছ আজ যেমন দেখছিস, আমাদের দাদার আমলেও ঠিক তেমনই ছিল।’

১৯৭১ সালের দিকে অলৌকিক এক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হান্নান। তিনি বর্ণনা দেন সেই ঘটনার। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলিটারিরা একটা গাড়ি নিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়াও সময় তেঁতুল গাছে তাদের গাড়ি বেঁধে যায়। এতে কয়েকজনকে এই গাছের ডাল কাটার অর্ডার দেয় তাদের কমান্ডার। গাছের সাতটা ডাল তারা কাটেন। যে চারজন ওই ডাল কেটেছিলেন তাদের মধ্যে তাৎক্ষণিক অসুখ দেখা দেয়। দুজন বুকধরফর করে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। বাকি দুজনের অবস্থাও খারাপ হয়ে মারা পড়েন।’

রাজশাহী সুগারমিলের এসবিএ পদে চাকরি করেন মো. আক্তার হোসেন। ১৯৭৯ সালে তিনি গাছে চড়ে ছিলেন। গাছে চড়ার আগে গাছতলায় থাকা মানতের দুধ আর কলা খেয়েছিলেন। তারপর গাছে চড়ে তেঁতুলসহ পেড়েছিলেন গাছে থাকা দুটি ঘুঘু পাখির ডিম। গাছা থাকা অবস্থাতেই দেখেন একটি ঘুঘু। পাখিটি হাতের খুব কাছে চলে আসে। সেটিকে বার বার ধরার চেষ্টা করে পড়ে যান গাছ থেকে। তারপর সঙ্গাহীন বিছানায় কাটিয়েছেন দুই বছরের বেশি। নাক দিয়ে তরল খাবারেই কাটাতে হয়েছে তাকে দুটি বছর। মুখে সেলাই পড়েছে, মুখটাও ব্যাকা হয়ে গিয়েছে ওই ঘটনায়।

তিনি আরো বেলেন, ‘হ্যাঁ দেখেছিলাম। বিছানা অজ্ঞাত অবস্থা ও কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরও নারী কণ্ঠে আমাকে ডাকতো। আমিও ঘোরের মধ্যে ছুটে চলে যেতাম। আমাকে বাড়ির লোক বা স্থানীয়রা অনেকবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলো। ঠিকভাবে ঘুমাতে পারতাম না। বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম আমার দাদার বাড়ি। সেখানেও একই সমস্যা হতো। পরে ক্ষমা চাই এসব বিষয় নিয়ে আর দুটি কালো খাসি মানত দেই। এখন আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।’

নুরুল ইসলাম নামের এক যুবক বলেন, ‘আমার মামা একবার ওই গাছের আশপাশে বসে প্রস্রাব করেছিলো। তারপর সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান।’

মেম্বার মো. আক্কাস আলী ৭৫ সালের দিকের আরো একটি অদ্ভুত ঘটনার গল্প বলেন, গাছটা প্রায় শুকিয়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। পাশেই একটি ভাটা ছিল। তখন ওই ভাটার মালিক স্বপ্নে দেখেন এখান থেকে ভাটা না সরিয়ে নিয়ে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। স্বপ্নপ্রাপ্ত আদেশে ভাটামালিক চলে যান এলাকা ছেড়ে। তখন আবার গাছটি প্রাণ ফিরে পায়, আবার ডালপালা সবুজ হয়ে উঠে।’

‘গাছের তলায় অনেকেই এখন বসে থাকেন। তাই চেয়ারম্যানের পরামর্শে গাছের পাড়টি টাইলস দিয়ে বাঁধানোর কাজে হাত দেয়। বালু আর সিমেন্ট মিশিয়ে স্যালো মেশিন দিয়ে পানি দেয়, কিন্তু পানি আর ভেজে না। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পানি যায় হরহর করে, তারপর বালু ভেজে না। উপস্থিত আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই। পরে ওই বালু আর সিমেন্টে পানি ছিটিয়ে তা ভেজানো হয়। অথচ, যে পানি গেছে তাতে দু’তিনটা বিল্ডিংয়ের কাজ করা যেতো।’

হান্নানের সেই মিলিটারি গায়েব হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমি তখন হাফপ্যান্ট পড়া ছেলে। মিলিটারিরা এদিক দিয়ে ৩-৪ টা বড় ট্রাকগাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। পথে তেঁতুল গাছের ডাল থাকা তারা সেটা কেটে ফেলেন। এতে ঘটনাস্থলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যান। পরে এই তেঁতুলতলার পথ দিয়ে শুধু ড্রাইভার খালি গাড়ি নিয়ে যায়। তারাও বলতে পারেননি ওই মেলেটারিদের হদিস। কেউ বলেন মুক্তিযোদ্ধারা মেরেছে, কেউ বলেন গায়েব হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেই সুগারমিলের ড্রাইভার আব্দুর রহমান আমার মামা তেঁতুলতলার পাশে একটি সরার গাছ বিক্রি করেছিলেন। গাছ বিক্রির কারণে তিনি পা কাটা পড়ে কষ্টে মারা যান। আবার যে এই গাছটি কিনেছেন তারও শুনেছি ক্ষতি হয়েছে। তিনিও মারা গেছেন।’

শতবর্ষী গাছটির ওপর দিয়ে চলে গেছে বিদ্যুতের তার। তারপরও বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এই গাছের ডালপালা কাটেন না। তারাও জানেন এই গাছের ভয়ঙ্কর সব কল্পকথা। 

মেম্বার আক্কাস আলী জানান, একবার পবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এলাকায় এসে এই গাছ কাটার কথা বলেন রাস্তা বড় করার জন্য। তিনি তাতে পরিষ্কার জানিয়ে দেন- ‘আমি মেম্বারশিপ ছেড়ে দেব তাও এই কাজ আমি কাটতে পারব না। আপনিও গাছ কাটতে যাবেন না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে সবার কাছে থেকে এই গাছের ঘটনা শুনে নিন। অতপর পবা ইউএনও আর গাছটি কাটেননি।

মেম্বার আক্কাস আলী বলেন, তেঁতুলগাছ ততক্ষণ না কাউকে কিছু বলে, যতক্ষণ কেউ তার ক্ষতি করে। এমনিতেই সেই গাছ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় নি। তবে তার সিস্টেমের বাইরে গেলে খবর আছে।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ