শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ২ নভেম্বর ২০২০

তিস্তাপারে নতুন আশা

তিস্তাপারে নতুন আশা

কখনও বানভাসি, কখনও খরায় পুড়ে ছাই। পানির জন্য যখন হাহাকার, তখন নদী ও মাঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। আবার যখন পানির প্রয়োজন নেই, তখন বাইরের অতিরিক্ত পানি ঢুকে বন্যা গ্রাস করে। এ যেন সর্বক্ষেত্রেই মরণদশা। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে এবার রক্ষা পেতে যাচ্ছে তিস্তাপারের মানুষরা। বর্তমান সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় এবার যেন শেষ হতে চলেছে উত্তরের কয়েক জেলার মানুষের পানি সংক্রান্ত সীমাহীন দুর্ভোগের দিন। সরকারের মহাপরিকল্পনার অধীনে বহুমাত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্যাটেলাইট শহর স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণে নতুন আশায় বুক বেঁধেছে তিস্তাপারের বাসিন্দারা। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেও কার্পণ্য করেনি তিস্তাপারের বাসিন্দারা। রোববার তিস্তা নদীপারের পাঁচ জেলা তথা লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও নীলফামারীর লাখো বাসিন্দা নদীর দুপাশে মিলে ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করে সরকারকে অভিনন্দন ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ মানববন্ধনের একটি রেকর্ডও গড়েছে তিস্তাপারের বাসিন্দারা। সময়ের আলোর লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও নীলফামারী প্রতিনিধিরা এসব তথ্য জানান।
তিস্তা নদী নিয়ে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করায় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর বহিঃপ্রকাশ ঘটে রোববার সকালে। পাশর্^বর্তী দেশের ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে পানি সমস্যায় মহাভোগান্তিতে পড়া তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটার অববাহিকার দুই পারে (সর্বমোট ২৩০ কিলোমিটার) সমাবেত হয় হাজার হাজার স্থানীয় বাসিন্দা। সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ২৩০ কিলোমিটারের এই মানববন্ধন শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর তিস্তা মহাপরিকল্পনায় তিস্তা অববাহিকার ওই পাঁচ জেলার জীবনধারা বদলে দিতে কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ করে সেচ প্রদান ছাড়াও বহুমাত্রিক উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, স্যাটেলাইট শহর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, অর্থনৈতিক জোন, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নৌপথ-বন্দর নির্মাণসহ তিস্তা সুরক্ষায় মহাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে  সরকার। এর মধ্যে ‘তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার’ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীগর্ভে ড্রেজিং, পাড় সংস্কার ও বাঁধানো এবং ভূমি পুনরুদ্ধার করা হবে। তা ছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় বাঁধ মেরামত করা হবে। নদী ড্রেজিং, অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, গ্রীষ্মকালে পানির সঙ্কট দূর ও নদীভাঙন প্রতিরোধ হবে। তিস্তা থেকে সৃষ্ট শাখা নদী ও অন্যান্য নদীতে ড্রেজিং ও পাড় নির্মাণ করে পানিপ্রবাহ সঠিক রাখা ও কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে নদীর পানি ব্যবহার করা যাবে। তাই দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ পেয়ে তিস্তাপারের মানুষগুলো কৃতজ্ঞতায় পালন করল দীর্ঘ মানববন্ধন। এই মানববন্ধনে পাঁচ জেলার তিস্তা নদীসংলগ্ন বিভিন্ন পয়েন্টে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দারা তিস্তার ভাঙন, বন্যায় ঢলের আঘাত আর শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকারের কথা স্মরণ করে। তারা বলেন, তিস্তার ভাঙনে বিলীন হওয়া জমি, বসতবাড়ি পুনঃ উদ্ধার করা জরুরি। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ঘুচবে। নদীভাঙন রোধসহ স্থানীয়দের বসতবাড়ি রক্ষা ও নদীর জমিও উদ্ধার করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট হওয়া সঙ্কটও দূর হবে। নদীর গভীরতা বাড়লে শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাব হবে না। এ ছাড়া বন্যায় ক্ষয়ক্ষতিও অনেক কম হবে।
আয়োজকদের অন্যতম তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগঠনের রংপুর অঞ্চলের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানি বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও মহাভোগান্তির অনেকটাই লাঘব হবে। তবে খরা থেকে বাঁচতে ও শুষ্ক মৌসুমে পানি সঙ্কট দূর করতে তিস্তা চুক্তি ও তার বাস্তবায়নও জরুরি।
লালমনিরহাটের ১৯ স্থানে মানববন্ধন : লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে তিস্তা নদীর মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে রোববার সকালে লালমনিরহাটে ঘণ্টাব্যাপী তিস্তার বাম তীরের ১৯টি স্থানে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই সময় জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় দোয়ানী, নিজগড্ডিমারী, ধুবনী, পারুলিয়া, ডাউয়াবাড়ী, হলদিবাড়ী, কিশামত নোহালী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, হাজিরহাট, কাকিনা, আউলিয়ারহাট, বাগেরহাট, মহিপুর সেতু, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা এবং সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি, রাজপুর ও গোকুণ্ডা ইউনিয়নের তিস্তা সেতু সংলগ্ন এলাকাসহ তিস্তার বাম তীরের নদীতীরবর্তী ১৯টি স্থানে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে।
তিস্তা রেল সেতু ও সড়ক সেতু মাঝের বাঁধে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেনÑ তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাট জেলা কমিটির সভাপতি গেরিলা লিডার শফিকুল ইসলাম কানু, সহসভাপতি অ্যাডভোকেট চিত্তরঞ্জন রায়, সাধারণ সম্পাদক বাদশা আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান, সাংস্কৃতিক কর্মী মাখন লাল দাস, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জহুরুল ইসলাম, আব্দুল খালেক ও গোলাম মাওলাসহ স্থানীয় ব্যক্তিরা। মানববন্ধনে আরশিনগরের শিল্পী শরিফা খাতুন তিস্তা নদীর ওপর দুটি ভাওয়াইয়া গান পরিবেশন করেন।
মানববন্ধনে তিস্তা মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তারা বলেন, খরা, বন্যা ও নদীভাঙনে তিস্তাপারের মানুষ দিশেহারা। নদীভাঙনের ফলে তিস্তা নদীর প্রস্থ কোথাও কোথাও ৫ থেকে ৮ কিলোমিটারেরও বেশি। ফলে দুই পারে লাখ লাখ মানুষ আবাদি জমিসহ বাড়িভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তিস্তা নদী দ্বারা দুই পারের মানুষ বর্ষাকালে বন্যায় এবং গ্রীষ্মকালে পানির অভাবে চাষাবাদ করতে পারে না। অন্যদিকে তিস্তার উজানে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় নাব্য না থাকায় তিস্তা এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে।
গাইবান্ধায় মানববন্ধন : গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, তিস্তা নদীর নাব্য পুনরুদ্ধার ও ভাঙনরোধের দাবিতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ও তারাপুর এলাকায় তিস্তা নদীর তীরে পৃথক দুটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে রোববার এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য আমিনুল ইসলাম গোলাপ, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মাসুদুর রহমান মাসুদ, উপজেলা জাসদ নেতা মুন্সী আমিনুল ইসলাম সাজু, ব্রহ্মপুত্র সড়ক সেতু আন্দোলন নেতা আশরাফ আলী, কামরুল ইসলাম, মাহবুবার রহমান টুকু, বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুজ্জামান, আসাদুল ইসলাম আজাদ, সাজু মিয়া ও হাসান খান।
বক্তারা বলেন, তিস্তা নদী পুনঃখনন ও ভাঙনরোধে দুই তীর রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে নদী নাব্য ফিরে পাবে। সে সঙ্গে নৌ চলাচল স্বাভাবিক ও কৃষি উন্নয়নে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। অবিলম্বে তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বক্তারা।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ