শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ || ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকাশিত: ১৮:৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২১

অন্ধকার থেকে আলোর পথে ৯ জঙ্গি!

অন্ধকার থেকে আলোর পথে ৯ জঙ্গি!

আমি যখন হিজরতে ছিলাম, তখন আমার ও পরিবারের উপর চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। নিজের কোনো সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবন ছিল না। আমার স্ত্রী একজন চিকিৎসক। কিন্তু জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার কারণে তার (স্ত্রী) জীবনেও চরম গ্লানি নেমে আসে। আর আমার সন্তানের জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। পুরো সমাজ ব্যবস্থা থেকেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয় গিয়েছিলাম। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে মসজিদে গিয়ে ঠিকমতো নামাজটাও পড়তে পারতাম না। গতকাল রাজধানীর কুর্মিটোলায় র‌্যাব সদর দফতরে আয়োজিত ‘নব দিগন্তের পথে’ জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন জঙ্গিবাদ থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪)। শাওনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তার স্ত্রী ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯) জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ভুল বুঝতে পারেন তারা।

শুধু শাওন ও তার স্ত্রী ডা. নুসরাতই নয়, গতকাল তাদের মতো আরো সাতজন র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা। এ সময় মন্ত্রী ফিরে আসা নয়জনকে তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দেন এবং তাদের পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা দেন।
ফিরে আসা জঙ্গিদের মধ্যে ছয় জন জেএমবি ও তিন জন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তারা হলেন- সিলেটের বাসিন্দা শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪), তার স্ত্রী ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), কুমিল্লার বাসিন্দা আবিদা জান্নাত আসমা ওরফে তারাদ ওরফে রামিসা (১৮), আবদুর রহমান সোহেল (২৮), চাঁদপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেন ওরফে হাসান গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), ঝিনাইদহ এলাকার বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম (৩১), চুয়াডাংগা এলাকার বাসিন্দা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬) ও মো. সাইদুর রহমান (২২)।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা শুধু জঙ্গিবাদ কঠোর হস্তে দমন করছি তাই নয়, পাশাপাশি ডির‌্যাডিকালাইজশনের মাধ্যমে তাদের ভুল পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তাদের ট্রাক্টর, কৃষিজ উপকরণ, নগদ টাকা সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ কখনো জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন জিরো টলারেন্সের কথা। এটা আমরা কখনো বলি না জঙ্গিবাদকে মূলোৎপাটন করেছি। বলেছি জঙ্গিবাদকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। অনেক দেশ থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তোমরা কিভাবে জঙ্গিবাদকে মোকাবিলা করছো? আমি বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ কখনো জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না বলেই আমরা জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।

তিনি আরো বলেন, পঞ্চগড়ে হিন্দু ইস্কন মন্দিরে পুরোহিতকে হত্যা, বৌদ্ধ পুরোহিতকে হত্যা, শিয়া মসজিদে নামাজরত অবস্থায় ঈমামকে গুলির দৃশ্য দেখেছিলাম। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে র‌্যাব এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। আজ তারই প্রতিফলন এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। নয় জঙ্গির আত্মসমর্পণের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা বিভ্রান্ত হয়েছিল, পথ হারিয়েছিল, যারা ভুল পথে ভুল আদর্শ বুকে নিয়েছিল তারা আজ বাবা মার কাছে ফিরেছেন, বাবা মার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন, যা অনেক দিন পর দেখছি। এজন্য র‌্যাবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, যারা এখনো ওই পথে আছো, তোমরা ফিরে এসো। ওই ককটেল, জর্দার কৌটা বা এ জাতীয় জিনিসপত্র দিয়ে তোমরা কারো বিরুদ্ধেই বিজয়ী হতে পারবে না। বরং ওই পথে গিয়ে তোমরা পরিবার-সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছো। বেঘোরে প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ অন্ধকার জগত তোমার নিজেকে, পরিবারকে ও রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলতে পারো।

বাংলাদেশ বার বার জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে এর কোনোটাই বাংলাদেশ থেকে সৃষ্টি হয়নি। প্রতিবারই বাইরের দেশ থেকে এসেছে, প্রতিবারই শান্তিপ্রিয় মানুষের সহায়তায় পরাস্ত করেছি। এখনো যারা এ ধরনের কাজে জড়িত আছেন তাদের প্রতি আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে। র‌্যাব, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, কাউন্টার টেররিজমসহ একাধিক টিম তাদের নজরদারিতে রেখেছে। আমাদের গোয়েন্দা কমিউনিটিও এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে। হয়তো পরিপূর্ণভাবে সব ঘটনা শুরুতে বিনষ্ট করতে পারিনি। ১০০ শতাংশ না হলেও অন্তত ৯০ শতাংশেরও বেশি ঘটনা শুরুতেই বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়েছি। যারা সমাজের মূলধারায় ফিরে এসেছে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, তোমরা আলোর পথের অভিযাত্রী, এটা দুঃসাহসিক কাজ। এজন্য তোমাদের অভিনন্দন। জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার এ ধারা বাংলাদেশই প্রথম চালু করেছে।
সভাপতির বক্তব্যে র‌্যাবের ডিজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, যারা আজ সমাজের মূলধারায় ফেরার জন্য আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের এ সমাজ যেন আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। তুই জঙ্গি বলে যেন তাকে আবারও নেতিবাচক পথের দিকে যেন ঠেলে দেয়া না হয়। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ একটা আদর্শিক সমস্যা, এটা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সঠিক ধর্মীয় ব্যাখ্যা। তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে চাই। আত্মসমর্পণ করা নয়জনের মধ্যে আটজনই তাদের পরিবারের কাছে ফেরত যাবেন। একজনকে আইনের কাছে সোপর্দ করা হবে। আইনি কার্যক্রমের মাধ্যমে পরবর্তীতে ফেরত যাবেন তিনি। র‌্যাব প্রধান বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমরা আভিযানিক কার্যক্রম আরও বেগবান করবো। কোথাও জঙ্গিরা টিকে থাকতে পারবে না। তাই যারা পলাতক আছেন আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করুন।

দৈনিক গাইবান্ধা

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

সর্বশেষ